হঠাৎ অচল হয়ে গেল!
বনের মধ্যে ঝিঁঝি পোকারা একতানে বেজে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন সুরে।
কিন্তু বাজছে শুধুই কি বনের মধ্যে?
.
০৫.
নীপা পাখাটার স্পীড শেষ সীমায় ঠেলে দিয়ে বসে পড়ে হতাশ স্বরে বলল, এই কথা বলেছিল সে?
শশাঙ্কও বসেছে হেঁটমুণ্ডে। মরীয়া হয়ে বলে ফেলেছে সে, সোনালীর চলে গিয়েও ফিরে এসে বলে যাওয়া শেষ কথাটা।
তবু এতর মধ্যেও কাণ্ডজ্ঞানটি একেবারে হারায় নি। সবটা বলে নি।
শুধু নীপার বারবার প্রশ্নে এক সময় জানিয়ে ফেলেছিল, যাবার সময় বলে গেল, হয়তো না ফিরতেও পারি।
এই কথা বললে, আর আপনি–নীপা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, কেন স্টেপ নিলেন না? একলা চলে যেতে দিলেন?
ওটাকে আমি একটা কথা বলেই ধরি নি।
ধরেন নি! আশ্চর্য!
অবশ্য আশ্চর্য হওয়াটাই নীপার বাড়াবাড়ি। দৈবাৎ একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল বলেই না ওই কথার কথাটায় গুরুত্ব আসছে!
শশাঙ্কদের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর বাড়ি থেকে নীপাদের দমদমের বাড়ি পর্যন্ত সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব রাস্তাগুলো গাড়ি ছুটিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে কোথাও কোন মোটর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কি না।
গাড়ির নাম্বার জানিয়ে থানায় থানায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। খোঁজ নেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য হাসপাতালগুলিতে।
আপাতত আর কি করবার আছে?
কে আর ভাবতে বসবে নীপার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেছে সোনালী নীপার বাড়ি ছাড়িয়ে অনেক অনেকটা দূরে।
.
ইচ্ছাকৃত নিরুদ্দেশ! বললেন নীপা-পতি মিস্টার দাশগুপ্ত, দেখাই যাচ্ছে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া। পুলিশ কেসে তো পড়তেই হবে মিস্টার সেন, এখন ঠিক করুন কি কি বলবেন।
কি বলব মানে?
আহা, আনুপূর্বিক বলতে তো হবেই? কোনও রকম কথা কাটাকাটি কলহ অথবা মনোমালিন্য হয়েছিল কি না, আর কারও সঙ্গে বিশেষ কোনও মেলামেশা ছিল কি না–
আঃ, থামো তো তুমি। ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে নীপা, সবাইয়ের সব কিছুই তোমার আদালতের নথিপত্তর নয়। কথা বলার সময় একটু বুঝেসুঝে বলতে হয়।
কী আশ্চর্য, আমি কি মন্দ ভেবে কিছু বলেছি, মিস্টার দাশগুপ্ত হতাশভাবে মাথা নাড়েন, ব্যাপারটা গোলমেলে এটা তো ঠিক?
অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া আর কিছু আমি ভাবতেই পারছি না, বলে শশাঙ্ক।
কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট ঘটাবেই এই সঙ্কল্প নিয়ে সে কি উত্তরপথের বদলে দক্ষিণপথ বেছে নিয়েছিল? অথবা পূর্ব-পশ্চিম যে কোনও পথ? তাহলে অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, আমাদের অনুসন্ধানটা নিতান্তই আংশিক ব্যাপার হয়েছে। আমরা সম্ভাব্যটুকুই দেখেছি। দিকে দিকে খোঁজ করতে হলে–।
আঃ, থামো তুমি, সব সময় আর সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করা তোমার একটা রোগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলল নীপা।
উৎসবশেষের বাড়িটা যেন ভাঙা মেলার মত দেখাচ্ছে।
অতিথি অভ্যাগত সকলেই একে একে বিদায় নিয়েছেন সহানুভূতি আর উদ্বেগ জানিয়ে। অনেকেই আশ্বাস দিয়ে গেছেন সকালবেলাই ফোনে খবর নেবেন।
এবং প্রত্যেকেই ঘরে ফিরে এই নিরুদ্দেশ পর্বটিকে একটি রোমান্সের রঙে ছুপিয়ে নিয়ে বহুবিধ রসালো আলোচনায় মুখর হচ্ছেন।
সোনালীর সঙ্গে যে তার স্বামীর সম্পর্কটা খুব একটা আদর্শ নয় কে না জানে?
নীপাই কি জানে না? তাই না নীপার মনের মধ্যেও ভয়ের কাপন! কে জানে সর্বনাশী পোড়ারমুখী কি করে বসল!
কিন্তু নীপা তার একান্ত বান্ধবী, আবাল্যের বান্ধবী, নীপা কিছু টের পেল না?
এই তো আজ সকালেও টেলিফোনে কত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে–বাবলীর জন্মদিন নিয়ে। দমদমে বাড়ি করা পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎ দূরবর্তী হয়ে গেছে, এইসব নিয়ে করেছে আক্ষেপ। ইতিমধ্যে এমন কি ঘটা সম্ভব?
আর শশাঙ্ক লোকটা আর যাই হোক, হঠাৎ ভয়ানক রকম একটা কিছু ঝগড়াঝগড়ি করে বসবার লোক নয়।
নীপা তো বরং মনে করে ওই রকম শান্তশিষ্ট স্বল্পবাক স্বামীই সংসারযাত্রার পক্ষে সুবিধেজনক।
কিন্তু সে যাক, এখন করণীয় কি?
করণীয় আর কি! দাশগুপ্ত বলেন, গাড়ির নাম্বারটাই এখন প্রধান ভরসা। সন্ধান নিতে হবে ওই সময়ের মধ্যে ওই রকম একটা গাড়ি শহরতলীর কোনও পেট্রলপাম্প থেকে তেল নিয়েছে কিনা, নিয়ে থাকে তো কোন দিকে গেছে?
কেউ যদি ইচ্ছা করে হারিয়ে যায়, তাকে কি খুঁজে পাওয়া যায়? অদ্ভুত সুরে বলে শশাঙ্ক।
আর সঙ্গে সঙ্গে ধমকে ওঠে নীপা, থামুন আপনি! রাখুন মেয়েলি কাদুনী। আশ্চর্য দায়িত্বহীনতা আপনার, না বলে পারছি না এ কথা–
বান্ধবীর স্বামী বে-পোট অবস্থায় পড়লে যতটা রসনা সঞ্চালন করা চলে তাতে ত্রুটি করে না নীপা।
২. শশাঙ্কর অবস্থা
০৬.
কিন্তু শশাঙ্কর অবস্থা আর এমন কি? কতটুকুই বা জব্দ হল সে?
ঝিঁঝি পোকা আর শেয়ালডাকা গ্রামের ধারে অন্ধকার আকাশের নীচে অচল গাড়ির মধ্যে বিমূঢ় সোনালী এই কথাই ভাবল, ওর আর কতটুকু কি হল? কি আর এমন জব্দ হল ও? সোনালী নিজেই যে–
আচ্ছা, এইভাবে সারাটা রাত কাটিয়ে দেওয়া কি খুব শক্ত? কি আর হবে চারিদিকে কাঁচ তুলে নিঃশব্দে বসে থাকলে? সকাল হলে যা হয় একটা ব্যবস্থা হবেই।
তাছাড়া উপায়ই বা কি? নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে বসে থাকাই যাক।
কিন্তু এ কল্পনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।
চারিদিক থেকে শেয়ালের ঐক্যতান শরীরের সমস্ত রক্ত ঝিমঝিমিয়ে তুলল।
হৃৎপিণ্ডের মধ্যে যেন একটা হিমপ্রবাহ বইতে সুরু করেছে, অথচ হাত পা কপাল উঠেছে ঘেমে।