কৌতুক! আপনি বলছেন কি মিস্টার সেন? এটা কি একটা কৌতুকের বিষয়? আপনার ড্রাইভার কি–কী বললেন? ড্রাইভার ছিল না? সোনালী নিজেই ড্রাইভ করে? ব্যস, আর কিছু ভাববার নেই, নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট কেস। আশ্চর্য, আপনি এই একা আসাটা অ্যালাউ করলেন কি করে? জানেন তো ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাবে। এতটা রাস্তা! উঃ, আমার তো ভেবে হাত পা আসছে না। ইস্, কেন যে আমি নেমন্তন্ন করতে গেলুম! ইমিডিয়েটলি থানায় হসপিটালে খবর নিন, আমিও নিচ্ছি এদিক থেকে। কোনখানে যে কি হল! উঃ, এ কী কাণ্ড!
এবার না বলেই ছেড়ে দিল নীপা!
গলার স্বর কাঁপছিল তার, উদ্ভ্রান্ত সুর। এ কখনো কৌতুক হতে পারে না। যেটা একটু আগেও আশা করছিল শশাঙ্ক। শশাঙ্ককে জব্দ করতে সোনালী বান্ধবীকে দিয়ে এই উদ্বেগের চাল চেলেছে।
কিন্তু আর সে কথা মনে করা চলছে না। এ খবর ঠিক। এ বিধাতার অমোঘ দণ্ড।
.
এবার তবে উঠে পড়ো শশাঙ্ক! খেসারৎ দাও তোমার জড়ত্বের, তোমার অলসতার, তোমার অপৌরুষের।
কিন্তু থানায় হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করলে কি হবে?
সত্যিৎ কি এ্যাকসিডেন্ট?
.
বিদ্যুৎচমকের মতো সোনালীর শেষ কথাটা মনে পড়ল।
.
০৪.
দুরন্ত অভিমানে উত্তপ্ত মস্তিষ্ক অনেকক্ষণ ধরে খোলা হাওয়া পেয়ে যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে এল, এল বিচার-বুদ্ধির কোঠায়, তখন কতটা যে রাত হয়েছে বুঝতে পারল না সোনালী।
অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছে হাতে বাঁধা ঘড়িটা। যথাসময়ে দম দিতে ভুলে গিয়েছিল কি ঘড়িটাতে?
ভুলের কথা মনে করবার উপায় নেই, তবু ঘড়িটার এই অদ্ভুত অসময়ে এমন নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হয়ে যাওয়াটা যেন পরিকল্পিত হিংস্রতার মত লাগল সোনালীর।
সবে ছটা বেজে থেমে আছে কাঁটা দুটো, অথচ এখন বেশ রাত মনে হচ্ছে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। আশেপাশে বসতির কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
হয়তো দিনের বেলা হলে দেখতে পাওয়া যেতো ওই ঝোঁপজঙ্গলের মাঝখান দিয়েই এখানে সেখানে বিধবার সিঁথির মত সাদা সরু একটু পায়ে চলা পথ, যে পথ চলে গেছে লোকবসতির মাঝখানে।
দেখা যেত দূরে দূরে ঘর-বাড়ির আভাস, যেগুলো সারা দিনের ছিটকে পড়ে থাকা মানুষগুলোর দিনান্তের আশ্রয়। যেখানে নিতান্ত দীনদুঃখী মানুষটার জন্যেও প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে উষ্ণ শয্যা, উষ্ণ অন্ন আর প্রেপোষ্ণ হৃদয়।
কিন্তু এখন চারিদিকে নিঃসীম অন্ধকার। এখন কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কলকাতার এত কাছাকাছি এত অন্ধকার আছে? আছে এমন জঙ্গল?
রাত্রে ভয়াবহতা বেশিই লাগছে। গাড়ির হেলাইট জ্বালিয়ে আসছিল, চারিদিকে খেয়াল করে নি, একটিমাত্র খেয়াল মাথার মধ্যে কাজ করছিল–শশাঙ্ককে বুঝিয়ে ছাড়া যে সোনালী : একটা অবহেলার বস্তু নয়। তার মূল্য আছে।
কিন্তু কী সেই পথ?
গল্পে উপন্যাসে যেমন মাঝে মাঝে পড়া যায়, অন্যের সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের ভান করে স্বামীর অথবা প্রেমাস্পদের মনোযোগ আকর্ষণ করা, তেমনি একটা কিছু করে দেখা যায় না? ঈর্ষাই শশাঙ্ককে তার ঔদাসীন্যের দুর্গ থেকে বার করে আনবে তাহলে।
কিন্তু সোনালীর এই অভিনয়ের পার্টনার কে হবে?
সম্ভব অসম্ভব নানা কল্পনায় কখন যে এতটা সময় কেটে গেছে। এখন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার বাসনা দূর হয়ে গিয়ে জেগে উঠলো একটা ভয়ের ব্যাকুলতা।
.
ছি-ছি-ছি, এ কী করে বসেছে সে! বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গিয়েছিল নাকি?
কে জানে এসে পড়েছে কোথায়, কে জানে কত রাত হয়ে গেছে? কে জানে কী বলছে তাকে নীপা?
উৎসবকক্ষের সকলেই যে আজ সোনালীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে তাতে আর সন্দেহ কি?
আচ্ছা, নীপা কি খবর নেবে না, তার সবচেয়ে প্রিয়বান্ধবী এল না কেন? কারণে অকারণে ফোন তো প্রায় একটা ব্যাধি তার। সোনালীর যেতে দেরি দেখলে অবশ্যই শশাঙ্ককে ফোন করবে সে।
হঠাৎ একটা প্রতিশোধের উল্লাস অনুভব করে সোনালী। নিশ্চয় ফোন করেছে নীপা, আর? ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে শশাঙ্কর।
খুঁজুক, সারারাত ছুটোছুটি করে বেড়াক সে। সোনালী এবার গিয়ে নীপার বাড়িতে আত্মগোপন করে বসে থাকবে, জানতে দেবে না সে এসেছে।
দেখা যাক, শশাঙ্ক কতটা কর্মক্ষমতা দেখায় নিরুদ্দিষ্টা স্ত্রীর সন্ধান করতে।
কিন্তু তাই কি হবে?
হয়তো শশাঙ্ক তার বইরাজ্যের মধ্যে মশগুল অবস্থাতেই ফোনটা ধরে বলবে, যায় নি ওখানে? কেন? বাড়ি থেকে তো বেরিয়েছে অনেকক্ষণ। তা আর কোথাও গেছে বোধহয়। বলে স্বামী-কর্তব্য সমাপনান্তে আবার ফিরে যাবে নিজের রাজ্যে।
সহসা চোখে এক ঝলক জল এসে যায়।
আজ যদি সোনালী মোটর অ্যাকসিডেন্ট করে মারা পড়ে যেতে পারত! বাড়ি থেকে অনেক দূরে কোথাও কোনও এক অপরিচিত অখ্যাত গ্রামের ধারে পথের একপাশে পড়ে থাকত সেই মৃতদেহ।
শশাঙ্ক এসে দেখত। দেখতো নিজের কীর্তি!
তা নিজের কীর্তি ছাড়া আর কি!
সোনালী কি মরতে উৎসুক? তার কত সাধ, কত বাসনা।
হঠাৎ বুকটা হু হু করে উঠল সোনালীর। এই অজানা গ্রামের ধারে পথের প্রান্তে মারা গিয়ে পড়ে থাকবার চিন্তাটা যেন ভয়ঙ্কর একটা শোকের মত হাহাকার এনে দিল।
না না, জীবনের এমন ভয়ানক পরিণতি চায় না সোনালী।
তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে নিল সোনালী আবার ফেলে আসা পথ পাড়ি দিতে।
আর মাত্র কয়েক গজ গিয়েইহা, কয়েক গজ মাত্র গিয়েই–গাড়িটাও ঘড়ির মতই একটা অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল।