তাছাড়া সংসারের গিন্নী কর্তার কড়া হুসিয়ার চোখের ওপর দিয়ে দুপয়সা হাতাতে পারলে তবেই না ফুর্তি। এ কী বাবা, সমুদুর শুষলেও কেউ তাকিয়ে দেখবার নেই। দশ টাকার নোট ভাঙিয়ে তিন টাকার জিনিস কিনে বাকী সাত টাকা ফেরত না দিলেও কেউ বলবে না, সে টাকাটা কই?
এ রকম জায়গায় টাকা সরাতে যেন গা ছমছম করে। নিজেকে পাষণ্ড পাষণ্ড লাগে।
এমন সংসারে থেকে নিয়েও সুখ নেই, খেয়েও সুখ নেই।
.
তেলের টিনটা ঠক্ করে বসানোর শব্দে নতুন ঠাকুর চমকে উঠল। তারপর অনন্তকে দুমদুম্ করে দোতলায় উঠে যেতে দেখে ব্যাপার বুঝে নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল, অনন্তটা আছে ভালো। আহা, অনন্ত যদি একবার দেশে যেত!
উজবুকের রাজা হলেও পয়সা সরানোর ব্যাপারটা বোঝে না এমন নয়!
অনন্ত এসে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিতেই চমকে উঠলো শশাঙ্ক!
কী আশ্চর্য, এতক্ষণ সে অন্ধকারে বসেছিল? হাতের বইটা হাতেই ধরে?
কিন্তু কতক্ষণ? কই, মনে তো পড়ছে না কী ভাবছে এতক্ষণ ধরে? কোনও কিছুই কি ভেবেছে?
বাবুর কি মাথা ধরেছে?
অনন্তর অপ্রতিভ কণ্ঠের প্রশ্নে আর একবার চমকালো শশাঙ্ক, কেন, মাথা ধরবে কেন? কে বলেছে মাথা ধরেছে?
আজ্ঞে, অন্ধকারে রয়েছিলেন তাই।
ও তাই। তা তুই আর লোকের বাড়ি ঘরমোছা বাজার করার চাকরি করছিস কেন, যা না ডাক্তারী করগে না, পশার হবে।
ডাক্তারী।
না তো কি। এত সহজে যখন রোগলক্ষণ বুঝে ফেলিস। কিন্তু এখন আগমনের হেতু?
আজ্ঞে বাবু কি বলছেন?
বলছি–কি চাই?
অনন্ত মাথা নীচু করে ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, আজ্ঞে তেল ফুরিয়েছে, তাই
তেল ফুরিয়েছে।
কী বিশ্রী, কী কদর্য, কী কটু? শব্দজগতে এর চাইতে কুৎসিত শব্দ আর আছে?
শশাঙ্কর মনে হয়, এর চাইতে কদর্য শব্দও আর নেই, আর শশাঙ্কর মতো হতভাগাও বুঝি জগতে আর নেই! সত্যি, এমন কোনো বিবাহিত হতভাগা আছে, যাকে জটিলতম কোনও দার্শনিক চিন্তার মাঝখানে সহসা শুনতে হয় তেল ফুরিয়েছে!
সংসারে অবিরত তেল ফুরোয়, চিনি ফুরোয়, আটা ফুরোয়, ময়দা ফুরোয়, হলুদ পাঁচফোড়ন লঙ্কা সর্ষে ফুরোয়, শুধু ফুরোয় না মানুষের সংসার করার বাসনা।
নিজের ওপর ভয়ঙ্কর রাগ হয় শশাঙ্কর। কেন সে মার একটু চোখের জল একটু আক্ষেপোক্তিতে ভুলে এই অলাতচক্রের ফাঁদে পা দিয়েছিল!
শুধু সে একা থাকলে একরাশ টাকা ওই বামুন-চাকরগুলোর হাতে ধরে দিয়ে বলতে পারত, যা, যা খুশি করগে যা। শুধু আমায় দুবেলা দুটি খেতে দিবি এই শর্তে, ব্যস। জ্বালাতন করতে আসবি তো পিটুনি খাবি।
কিন্তু তা হল না।
এখন বারবার আয়ব্যয়ের হিসেব দেখতে হয়। নইলে সোনালীর সব চাহিদা মিটিয়ে ওঠা শক্ত হয়ে ওঠে।
এ নিয়ে অনেক তর্ক হয়ে গেছে সোনালীর সঙ্গে। সে সাফ জবাব দেয়, আমারও ওসব ভালো লাগে না। আমারও অসহ্য ওই হলুদ পাঁচফোড়ন আলু মাছ। তোমার যাতে বিরক্তি আসে, আমারই বা তাতে আনন্দে আসবে ভাবছ কেন? আমি পারব না, আমার দায় কিসের?
গৃহের গৃহিণী যদি বলে, আমায় দায় কিসের? কতক্ষণই বা তর্ক চালানো যায় তার সঙ্গে?
অথচ মাঝে মাঝেই সে হেসে হেসে বলে, তোমার সংসারের ম্যানেজারী করে করে তোমার বামুন-ঠাকুর তো দেশে জমিদারী করে ফেলল!
সেটাই স্বাভাবিক। বলে শশাঙ্ক গম্ভীর মুখে।
সোনালী নাক বেঁকিয়ে বলে, তা বটে। শুধু আমি টাকার কথা বললেই মুখ শুকিয়ে যায়। ঠাকুরের কত দেশভাই বারোমাস এখানে এসে রামরাজত্বে থাকে, সন্ধান রাখো?
ওটা আমার সন্ধান রাখার কথা নয়।
কথায় কথা বেড়ে উঠেছে, শেষ পর্যন্ত শশাঙ্ককে থেমে যেতে হয়েছে।
.
নোটে টাকায় খুচরোয় মুঠো ভর্তি করে অনন্তর দিকে বাড়িয়ে ধরে শশাঙ্ক, এই নাও, হবে এতে?
অনন্ত হাত বাড়ায় না, ভারী মুখে বলে, আমার ওপর রাগ করছেন কেন বাবু? আমার কি দোষ?
রাগ? তোর ওপর রাগ করছি? হেসে উঠল শশাঙ্ক, রাগ জিনিসটা কি এতই সস্তা রে অনন্ত?
এ সব ঝামেলা আমার ভালো লাগে না বাবু!
কিসের ঝামেলা রে?
এই এটা নেই ওটা নেই, আনতে হবে, পয়সা চাইতে হবে। মা কিছু দেখবেন না।
আর টাকার দরকার আছে তোমার?
অনন্ত সহসা এই গম্ভীরকণ্ঠের ব্যঙ্গে থতমত খেয়ে টাকাগুলো নিয়ে অনুচ্চকণ্ঠে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
.
চমৎকার সংসার করছি আমি! মনে মনে বলল শশাঙ্ক। তারপর ভাবল আর সব লোকেদের মতন হতে পারি না আমি? সোনালী যেমন চায়? সোনালীর জামাইবাবুর মতন রোজ সকালে বাজারে গিয়ে বেছে বেছে মাছ তরকারি
.
টেলিফোনটা বেজে উঠল।
বাঁচা গেল, ওই বিদঘুটে কল্পনাটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল আপাতত।
উঃ, কী করে যে মানুষ ইচ্ছে-সুখে বাজার যায়! কে?
আমি নীপা কথা বলছি। সোনালী এত দেরি করছে কেন? চলে আসুক তাড়াতাড়ি..কী বললেন, বেরিয়ে পড়েছে? কখন?…পাঁচটা নাগাদ?..সে কী? পথে আর কোথাও যাবার কথা আছে?…নেই? তাহলে? এত দেরি হবার তো কথা নয়।..কি বললেন, প্রেজেনটেশান কিনতে?… আঃ কী মুশকিল, এ সব নিয়ে আবার দেরি করা কেন, শুভেচ্ছাই তো যথেষ্ট। যাক, এসে পড়বে বোধহয় এখুনি। আচ্ছা, ছাড়লাম!
.
কিন্তু সেই ছাড়া রিসিভারই যে আবার ঘণ্টাখানেক পরে তুলে নিয়ে ডাকাডাকি করতে হবে নীপাকে, এ কথা কি নীপাই ভেবেছিল না শশাঙ্কই ভেবেছিল।
এখনো পৌঁছোয় নি সোনালী–এই সংবাদটাই পরিবেশন করতে হচ্ছে নীপাকে।
এখনো পৌঁছোয় নি। স্তব্ধ বিস্ময়ে মুহূর্ত কয়েক কাটে, তারপর প্রশ্নাঘাত শশাঙ্কর দিক থেকেই, কী বলছেন! আমি কি ভেবে নিশ্চিত হতে পারি না, আপনার বান্ধবী আপনাকে দিয়ে আমার সঙ্গে খানিকটা কৌতুক করছেন?