.
আঃ কি বিশ্রী জায়গাতেই বাড়ি করেছে নীপা!
লোকালয় ছাড়িয়ে গাড়ি যাচ্ছে এখন পথের দুধারে ঝোঁপঝাড় গাছপালা মাঠ জঙ্গলকে রেখে রেখে। মাঝখানে অনেকখানি পথ এই রকমই চলবে।
আবার ওদিকে জনবসতি। ভালো ভালো নতুন বাড়ি। যে রকম একখানি বাড়ির মালিক আজ সোনালীর বাল্যবান্ধবী নীপা।
সোনালীর শ্বশুরের অনেক বাড়ি!
তিন চারটে ভাড়া খাটে, একটাতে বাস করে সোনালীরা। সব থেকে ভালটাতেই করে তবু এক এক সময় হতাশ নিঃশ্বাস পড়ে সোনালীর। নিজের পছন্দমতন ছবির মত সুন্দর নতুন একটা বাড়ি সে এখনো করতে পারে না।
হয়তো বা তেমন একটা বাড়ি তৈরি করতে পারলে, নতুন ধাঁচে আর নতুন নতুন আসবাবে তাকে সাজাতে পারলে, শশাঙ্ককেও খানিকটা নতুন করে তুলতে পারত সোনালী! পুরানো অভ্যাসের খাঁজে খাঁজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া ওর স্তিমিত চেতনাকে নাড়া দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খানিকটা প্রাণবন্ত করে তুলতে পারত।
কিন্তু তা হবার নয়। এই বাড়িটাই শুধু দামী নয়, রাস্তাটাও কলকাতার সেরা রাস্তার একটি।
কিসের অজুহাত তবে সৃষ্টি করা যায়? অতএব এখানেই কাটাতে হবে সোনালীকে মরণাবধি।
কাটাতে হবে ওই গাঢ় গাঢ় মেহগিনীরঙা বহু বাহুল্যকারুকার্যখচিত আসবাবপত্রের মাঝখানে ওই বইপোকা মানুষটাকে নিয়ে। কত আর ছুটে ছুটে অন্যখান থেকে আহরণ করতে যাবে জীবনের রূপ রস রঙ?
সহসা একটা ধিক্কারের আলোড়নে মনটা উত্তাল হয়ে উঠল। সহসাই মনে হল, মানুষের এত নিরুপায়তা কিসে? হাত-পা-ওলা আস্ত একটা গোটা মানুষের?
আকাশে তখনও আলো। কিন্তু মাঠের ঝোঁপঝাড়ে অন্ধকার নেমেছে। আর একটু পরেই চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ভরে যাবে। অন্ধকারে ভরে যাবে আকাশটাও। টানা বড় রাস্তাটায় খানিক ব্যবধানে আলোর ব্যবস্থা।
কিন্তু বড় রাস্তা ছাড়িয়ে যেদিকে সেদিকে ইচ্ছে ওই আলভাঙা মেঠো রাস্তায় গিয়ে পড়লে?
একটা মানুষের হারিয়ে যাওয়া কি এতই কঠিন?
ধরিয়ে দেবে গাড়ির নম্বর? হারিয়ে যেতে দেবে না? গাড়িটাই যদি ত্যাগ করা যায়?
দুরন্ত অভিমান বুদ্ধিবৃত্তি আচ্ছন্ন করে দিতে চাইছে।
দমদমের কাছে নীপার বাড়ি। সেই কাছ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর ছাড়িয়ে চলে গেলে ক্ষতি কি?
অন্তত এই উত্তপ্ত মন নিয়ে চট করে এক্ষুনি নিমন্ত্ৰণবাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া সবচেয়ে অসুবিধের ব্যাপার বটুয়ার মধ্যে সেই একশো টাকার নোটখানা অভঙ্গ অবস্থাতেই রয়ে গেছে, কিছু কিনে নেওয়া হয়নি। খেয়াল হয়নি।
এখন এই লোকালয়শূন্য জায়গায় কোথায় কি? অথচ উপহারশূন্য হাতে উৎসববাড়িতে ঢোকাও তো অসম্ভব!
জীবনে একবার বেপরোয়া হয়ে দেখলে কী হয়? গাড়ির স্পীডটা বাড়িয়ে দিলো সোনালী। বেপরোয়া বেগে।
তেল আছে, অনেক তেল!
.
০৩.
তেল নেই!
এক ফোঁটাও না।
টিনটা কাৎ করে, উপুড় করে ঝাঁকিয়ে, কোনও প্রকারেই এক ফোঁটা বার করা গেল না।
মুখখানা পেঁচার মতন করে মিনিট দুই বসে রইল অনন্ত, তার পর উঠে পড়ল দুমদুম্ করে।
ভালো এক জ্বালা হয়েছে তার! পুরনো ঠাকুরটা চলে গিয়ে পর্যন্ত তার ঘাড়ে পড়েছে ভাঁড়ারের তদারকি। নতুন ঠাকুর তো উজবুকের রাজা।
রোজ রোজ কে এত হিসেব রাখেকখন তেল ফুরোললা, আর কখন চিনি ফুরোলো!
শুধু হিসেব রাখাই তো নয়, বাবুর কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনে আবার যোগান রাখা।
অনাছিষ্টি ছিষ্টিছাড়া এ সংসার! অনন্তর এত বন্ধুবান্ধব আছে, তার মনিববাড়ির মতন মনিববাড়ি কারুর নয়। বাড়ির যিনি গিন্নী তিনি যেন কুটুম্ব, যেন স্বর্গের পরী! তার পান থেকে চুনটি খসবার জো নেই, তারপর তোমাদের যা হয় তোক! ভাঁড়ারের আছে নেই বলতে গেলেই তিনি নাক কুঁচকে বলেন, ও সব কথা আমায় বলতে এসেছ কেন?
এ আবার কেমন আদিখ্যেতা, ভগবান জানেন। বাড়ির গিন্নী, উনি রাতদিন সাজবেন গুজবেন আর হাওয়া-গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবেন! ধন্যবাদ!
বাড়ির কর্তা অবিশ্যি গঙ্গাজল, কিন্তু বই-কেতাব নিয়ে বসে থাকা মানুষটার কাছে গিয়ে টাকা দাও, টাকা দাও করে উৎপাত করতে লজ্জা করে না?
টাকার হিসেব ওঁকে দিতে হয় না সত্যি, সেদিকে সুবিধে অনেক, তবু এক-এক সময় ভারি বেজার লাগে অনন্তর। কেন রে বাপু, অনন্তরই বা যত দায় কেন?
পুরনো ঠাকুর একেবারে সংসার খরচের মাসের টাকা নিয়ে নিত! তার থেকে কত গুছিয়েই নিল লোকটা! দেশে জমিজমা চাষবাস মাছের পুকুর! দুদুটো মেয়ের বিয়েও দিয়ে ফেলেছে।
অনন্তকে তোকই পুরো মাসের মাসকাবারির টাকা দিয়ে দেয় না বাবু! বিশ্বাস নেই, না অভ্যাস নেই? যা থাকে কুল-কপালে, আজ অনন্ত সেই প্রস্তাব করে বসবে। যতদিন না ঠাকুর দেশ থেকে আসছে!
এ বাড়ির না আছে বাপ, না আছে মা, না আছে ছাত, না আছে মাটি। এ সংসারে কাজ করা ঝকমারি!
.
ঠাকুরের মুখেই সব শোনা, বাবুর মা যখন বেঁচেছিলেন, তখন নাকি সোনার সংসার ছিল। মাইনে করা লোকজন ভাড়ার ঘরে ঢুকতেই পেত না। গিন্নী নিজে স্নানান্তে তসর-গরদ পরে তবে ভঁড়ারে ঢুকতেন। তা সেও ভালো ছিল, সংসারে লক্ষ্মীশ্রী ছিল।
কিন্তু এ কী! সংসার, না মেসবাড়ি! মেয়েমানুষ অলক্ষ্মী হলে কি আর সংসারের আঁটবাঁধ থাকে? আমি তো ওনাদের সোনার সংসারের আমলের নই, তবু এ ভূতুড়ে বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। বামুন-ঠাকুরের মতন অনন্তর অমন শুধু পয়সা গুরু, পয়সা ইষ্ট নয়।