তবু বাধ্য হয়েই করতে হয়, উপায় কি! ধারকে ঘৃণা আমিও কম করি না! কিন্তু প্রয়োজনের সময় নিজের ঘর থেকে না পেলে–।
প্রয়োজনের পরিধি অবিরত বাড়িয়ে চললে এ রকম অভাবও তো মুহুর্মুহুই দেখা দেবে।
সহসা একটু গুম হয়ে যায় সোনালী, তারপর তিক্তকণ্ঠে বলে ওঠে, তবে তুমি কি চাও? মানুষের জীবনে প্রয়োজনের সীমা উত্তরোত্তর সংকীর্ণ হয়ে আসবে? তা তোমার মত ঘরকুনো বইপোকার উপযুক্ত কথাই বলেছ। কিন্তু আমাকে দিয়ে তা হবে না, বুঝেছ? আমি সামাজিক জীব, আমার মানসম্ভ্রম আছে, লোকসমাজে মুখ রাখবার দায় আছে, ইচ্ছে বাসনা শখ সাধ আছে—
শশাঙ্ক হাতের ইশারায় কথাটা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর হাস্যে বলে, দ্যাখো ড্রয়ারটা খুলে এত চাহিদা মেটানোর যোগ্যতা ওর আছে কিনা।
হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে একটা চাবি ঠেলে দেয় শশাঙ্ক বইয়ের স্কুপের খাঁজ থেকে।
মুহূর্তে সামনের ড্রয়ারটা খুলে ফেলে দ্রুত অসহিষ্ণু হাতে সবকিছু ওলট-পালট করে একটা একশো টাকার নোট তুলে নিয়ে ড্রয়ারটা ফের এক ধাক্কায় ঠেলে বন্ধ করে দিল সোনালী। চলতিমুখো হয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, খুচরো দেখছি না, আস্তটাই নিলাম। যাচ্ছি তাহলে।
দলীপকে নিচ্ছ না?
না।
নীপার বাড়ি তো সেই দমদমের কাছে। ফিরতে রাত হবে অবশ্যই, অত রাত্রে একা আসার চাইতে।
না, না। অসহিষ্ণু কণ্ঠে ঝঙ্কার তোলে সোনালী, একা বলে দরদ দেখাবার কোনও দরকার নেই। নেমন্তন্ন নীপা আমায় একা করে নি, তোমাকেও করেছিল।
আমাকে! আমি কি কোথাও যাই?
যাও না, সেটা বাহাদুরীর কিছু নয়। যাক, এ নিয়ে অনেক দিন অনেক তর্ক হয়ে গেছে, কতকগুলো কথার সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু হয় নি।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সোনালী, আর বেরিয়ে গিয়েও সহসা আবার ফিরে এসে বলে উঠল, জানি দেরি হলেও বসে বসে ভাববে না, তবু বলে যাচ্ছি, বেশি রাত হতে পারে। অথবা একেবারে না ফিরতেও পারি।
না ফিরতেও পারো!
শশাঙ্কর কথাতেও প্রশ্নের সুর ফুটল না, না বা ফুটল বিস্ময়ের, শুধু সোনালীর বলা কথাটাই আবার উচ্চারণ করল।
হ্যাঁ। সোনালীর মুখে একটা তিক্ত ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল, তোমার কাছে তুচ্ছ হতে পারি, কিন্তু এখনো একটু কৃপাকটাক্ষে ধন্য হয়ে যায় এমন লোকেরও অভাব নেই জগতে। সেই জগতটা যাচাই করতে বেরোব ভাবছি।
গটগট করে বেরিয়ে গেল এবার সোনালী।
সত্যিই গেল।
.
০২.
গাড়িতে কেউ নেই তাই হাত তুলে চোখ মোছবার দায় নেই। কিন্তু তপ্ত একটা অশ্রুবাষ্পে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সোনালীর।
কী লজ্জা! কী অপমান!
নেমন্তন্ন বাড়িতে সবাই যাবে যুগলে, শুধু সোনালীকে যেতে হবে বিধবার মতো একাকিনী।
যখন যেখানে যাবে এই এক পদ্ধতি। সাধারণ নিয়মের ধার ধারবার দায় নেই শশাঙ্কর, তার একমাত্র যুক্তি, সবাই তো জানে আমি এই রকমই।
আমি উকট, আমি অদ্ভুত, আমি অস্বাভাবিক–এইটা কি একটা যুক্তি?
প্রথম প্রথম রেগে কেঁদে ঝগড়া করে কোথাও কোথাও সঙ্গে যেতে বাধ্য করেছে শশাঙ্ককে। কিন্তু নিয়ে গিয়ে পাঁচজনের মাঝখানে শশাঙ্কর আড়ষ্ট আড়ষ্ট বন্ধনদশাগ্রস্ত ভাব শুধু লজ্জাই দিয়েছে সোনালীকে।
অতএব সে চেষ্টা ত্যাগ করতে হয়েছে।
সোনালীর জন্যে ভাবনার শেষ নেই বাবুর!
আচমকা একটা রাগের উত্তাপে চোখের জল শুকিয়ে উঠল। কর্তব্যের মধ্যে কি? না, রাতে একা ফেরার বিপদ কল্পনা করে ড্রাইভারকে সঙ্গে নেবার অনুরোধ!
এইতেই আরও হাড় জ্বলে যায় সোনালীর। হলেও দলীপসিং বয়স্ক, লোকটার ভাবভঙ্গী ভালো লাগে না সোনালীর। চোখের চাউনিটাও যেন কেমন ধূর্ত-ধূর্ত।
হতে পারে এটা সোনালীর ভুল ধারণা, কিন্তু ভুল জেনেও কি বদ্ধমূল একটা ধারণার মূল উৎপাটন করা সহজ?
কিন্তু মনের এই ভয়কে প্রকাশ করা চলে না। সেটা খেলোমি। তাই সোনালী শশাঙ্কর কাছে অকারণ আপত্তি তুলে জানায়,–চোখের সামনে ওই বুড়ো শিখটার পাগড়ীপরা মাথাটা বেশিক্ষণ বরদাস্ত করতে পারি না।
.
গাড়ি চলছে। চলছে চিন্তার ধারা। দ্রুত উদ্দাম।
সোনালীর ভাগ্যে সুখের সমস্ত উপকরণ মজুত থাকতেও সুখ নেই।
এই তো এখুনি নিমন্ত্ৰণবাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট প্রকট হয়ে উঠবে সেই দৈন্য। যারা প্রত্যেকেই ভালো করে জানে, শশাঙ্ক ওই রকম, তারাও পরম অমায়িকমুখে হাসিচাপা সহানুভূতিতে বিগলিত হয়ে বলে উঠবে, ওমা, এল না! আজও এল না! আশ্চর্য!
সোনালীর ইচ্ছে করে সেও বলে ওঠে, আশ্চর্য, আজও তোমরা আশ্চর্য হও, কিন্তু পারে না। গলা বুজে আসে। সেই বোজ বোজা গলায় যা হোক একটা কৈফিয়ৎ দিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে বসে সে সভায়, যেখানে প্রায়শই যুগল ছবি।
বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিমন্ত্ৰণবাড়িতে আসার ফ্যাসান আর নেই, ভাইবোন মা ইত্যাদির প্রশ্ন তো ওঠেই না। নিতান্ত যে বেচারা জোড়ভাঙা, সে বাদে সকলেই জোড়ে আসেন। আর সেই হেন সভায় সোনালী তার অসামান্য রূপ, অটুট বয়েস আর অনবদ্য সাজ নিয়ে বসে বসে নিষ্ফল আক্রোশে জ্বলতে থাকে।
তবু আসেও তো!
নিজেকে নিজে অনেক সময় এ প্রশ্ন করেছে সোনালী, কেন আমি যাই? শুধু খানিকটা দাহ ছাড়া আর কিছুই তো সঞ্চয় হয় না, তবে কেন যাই লোক্সমাজে?
এর উত্তর স্পষ্ট হয় না।
প্রতিজ্ঞা করে, আর কোথাও যাবে না, কিন্তু না গিয়ে পারে না। লোকসমাজ তাকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানতে থাকে।