কিন্তু গেটের সামনে গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে কখন? সোজাসুজি রোদের দিকে তাকিয়েই ভুরু কুঁচকে দেখল শশাঙ্ক, হ্যাঁ তারই–মানে তাদেরই গাড়ি। সোনালী তাহলে এখনো বেলোয় নি। তার মানে আর একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই সোনালীকে দেখতে পাওয়া যাবে। সেই তার চকচকে ঝকঝকে আঁটসাঁট শরীরটা বেরিয়ে আসবে বাড়ির মধ্যে থেকে, ছোট্ট লনটুকু মুহূর্তে পার হয়ে গাড়িটার কাছে এসে একবার দাঁড়াবে। আর একবার চোখ তুলে দোতলার জানলার দিকে তাকাবে সে।
এটা নিয়ম।
রোজই তাকায়। টেবিলের ধারে চেয়ারে বসে বসেই দেখতে পায় শশাঙ্ক। আর দেখার পর মনে হয়, বোধ হয় জানলায় কাউকে আশা করে সোনালী।
কাকে? শশাঙ্ককে?
তাছাড়া আর কে আছে বাড়িতে? অন্তত আশা করবার মতো কে আছে? কিন্তু কেন? এত বড় দিনটায় একই বাড়িতে থেকেও স্বেচ্ছায় যে একবারও শশাঙ্কর সঙ্গে চোখাচোখি হবার ক্লেশটুকু স্বীকার করতে চায় না, সে কেন এ আশা করতে যাবে? দেখা এক এক দিন সমস্ত দিন-রাতেই হয় না। দুজনের গতিবিধি আলাদা, ঘুমের সময় আলাদা। রাতের খাওয়াটা একসঙ্গে বটে, তাও সব দিন নয়।
.
আশ্চর্য অঘটন ঘটল।
সামনের ওই দূর রাস্তায় দেখা নয়, এই ঘরের মধ্যেই পিছনের দরজা দিয়ে এসে প্রবেশ করল সোনালীর প্রসাধনমার্জিত আঁটসাঁট ছিপছিপে শরীরটি।
সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরক্ত কণ্ঠস্বরও ছড়িয়ে পড়ল ঘরের হাওয়ায়, পড়ন্ত রোদটায় মুখ দিয়ে বসে আছো যে?
শশাঙ্ক চমকে ঘাড় ফিরিয়ে অপ্রতিভ হাসি হাসল–এমনি!
এমনি! বাঃ চমৎকার! তার মানে, উঠে জানলাটা বন্ধ করে দেওয়া তো দূরে থাক, একটু সরে বসবারও ক্ষমতা হয় নি, কেমন? তা বইয়ের মধ্যেও তো ডুবে ছিলে না যে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলে, রাস্তায় কি দেখছিলে হাঁ করে?
শশাঙ্ক এবার মৃদু হাসে। হেসে বলে, হাঁ করে দেখার মত জিনিসের কি অভাব আছে জগতে?
হুঁ, কথাবার্তা তো বেশ ভালোই শিখছ ক্রমশ। ব্যাপারটা কি?
আমিও তো তোমাকে ওই প্রশ্নই করব ভাবছিলাম, ব্যাপারটা কি? এ সময় বাড়িতে? আবার এ ঘরে?
সোনালী তার গাঢ় রঙে ছোপানো ভুরু দুটো কুঁচকে বলে, কেন, আমি কি কখনো আসি এ ঘরে?
ও কথা থাক। আজ কি জন্যে?
কেন, কারণ না থাকলে নিজের বরের ঘরে আসতে নেই?
শশাঙ্ক একবার মুখ তুলে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর মৃদু হেসে হাতের বইখানাতেই চোখ রাখল।
রোদের সেই ছুরির ধারটা আর নেই, লালচে হয়ে এসেছে। আকাশ কত তাড়াতাড়ি বদলায়!
শোনো, কিছু টাকা চাই!
জানতাম। আর একবার মৃদু হাসল শশাঙ্ক।
সোনালীর মুখটা একবার একটু বিবর্ণ দেখাল, একটু বা বিপন্ন, তারপরই সামলে নিলো সে। তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, জানাই স্বাভাবিক। আর কোনও সম্পর্ক তো নেই দুজনের মধ্যে। কেন, বেরিয়ে পড়তে পারো না আমার সঙ্গে? খোলা আকাশের নীচে, পৃথিবীর আলোয়? যেখানে মানুষ থাকে, জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ।
শশাঙ্ক বিব্রতভাবে বলে, ছুটি ফুরিয়ে আসছে, পড়াটড়া তো তেমন কিছুই হল না
তেমন কিছুই হল না! প্রশ্ন নয়, ধিক্কার নয়, বিস্ময় প্রকাশ নয়, যেন একটা যান্ত্রিক শব্দ উচ্চারিত হল, তেমন কিছুই হল না! এই দুদুটো মাস গরমের ছুটি গেল, একখানা খাতা দেখার কাজ পর্যন্ত নিলে না, একবারের জন্যে বাড়ি থেকে বেরোও না, সারাদিন এই ভ্যাপসা গুমোট ঘরের মধ্যে পড়ে আছে। তবু আশ মেটে না, তবু পড়া হয় না! আশ্চর্য! যাক, আমার কিছুতেই কিছু এসে যায় না। পড়ো, আরও পড়ো, পড়ে পড়ে চোখের নার্ভগুলো জখম করে ফেলল, তারপর চিরতরে পড়ার ক্ষমতা ঘুচে যাক, মন্দ কি!
শাপ দিচ্ছো?
পারলে দিতাম। কিন্তু এটা শাপ নয়, শুধু ভবিষ্যৎ পরিণতির ছবিটা চোখের সামনে তুলে ধরা। বইপোকাদের ওই অবস্থাই ঘটে। যাক এই বলে যাই, নীপার মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্ন করেছিল তাই যাচ্ছি। গোটা পঞ্চাশ টাকা দাও, যাবার সময় একটা প্রেজেনটেশন
এতক্ষণে শশাঙ্ক কথা বলে। অথবা এতক্ষণে কথা বলার অবকাশ পায়। তাই বলে, টাকার জন্যে সব সময় অসুবিধে পাবার হেতু কি? সব টাকাকড়ি তুমিই রাখো না?
নাঃ, ঝিলিক দিয়ে ওঠে সোনালী, ও আমার ভালো লাগে না। কোথা থেকে তোমার টাকা আসছে, কখন তোমার কোন বাড়ির ভাড়াটে ভাড়া দিচ্ছে না, আর কখন কোন বাড়ির ভাড়াটে উঠে যাচ্ছে, এইসব হিসেবও তো রাখতে হবে তাহলে? উঃ বাপস! তাছাড়া এই তোমার সংসারের তেল নুন লকড়ির হিসেব! রক্ষে করো। ও সবের মধ্যে আমি নেই। আমার দরকার মত পেলেই হল।
শশাঙ্ক কি কষ্টে একটা রূঢ় কথা সংবরণ করে নিলো কে জানে। তবে কথা যা বলল সেটা মোলায়েমই।
এমনও তো হতে পারে দরকারমত সময়ে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
তার মানে?
মানে অন্য কিছু নয়। জানো তো আমাদের কলুটোলার বাড়ি দুটোর যা অবস্থা হয়েছিল, এই বেলা মেরামত না করলে কর্পোরেশন থেকে কোন দিন ভেঙে দিয়ে যেত, তাই ভাড়াটে তুলিয়ে দিয়ে মেরামত করানো হচ্ছে। ওতেই তো মাসে সাড়ে চারশো করে টাকা
তোমার ওই সব দৈন্যদশার কথাগুলো আমার কাছে না বললেই বাধিত হব। ও সব। শোনবার রুচি নেই আমার। দিতে না পারো তো বলল, বাইরের কারও কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছি আপাতত
শশাঙ্ক সহসা একটু দৃঢ় হয়ে উঠল। বুঝিবা একটু রুক্ষও, এই ধরনের কথা তুমিও আমার সামনে না বললেই বাধিত হব। ধার করাকে আমি কত ঘৃণা করি সে কথা তুমি জানো না তা নয়, তবু