বড্ড বেশি অত্যুক্তি হয়ে যাচ্ছে না নীপা?
অত্যুক্তি?
তা ছাড়া আর কি? যার যা অসাধ্য, সে তা—
অসাধ্যসাধন করিয়ে ছেড়েছ তুমি বলে টেলিফোন তুলে নেয় নীপা।
কে? ও তুমি। বাবু বাড়ি নেই?…কতক্ষণ বেরিয়েছেন?…ভোরবেলা? আচ্ছা, এলেই বলে দিও মা এসেছেন…হা হা, এখানেই আছেন।…হা ভালো আছেন।..ও সে কথা পরে শুনো। বাবুকে বলবে বাড়ি ফিরেই যেন সোজা এখানে চলে আসেন। হা হা, আমার এখানে। বুঝতে পেরেছ তো আমি কে? পেরেছ? ঠিক আছে। তোমাদের বাবু আজ এখানেই খাবেন বলে দিও সে কথা। এসেই চলে আসেন যেন।
সরে এসে বলে নীপা, এত করে অনুরোধ করবার কথা নয়, হারানিধি পাওয়া গিয়েছে শুনে উন্মত্ত হয়ে ছুটে আসবার কথা, কিন্তু যা উদোমাদা মানুষ হয়তো ভাববেন, যাক, এসেছে, ভালো আছে, আর চিন্তার কি!
তা সত্যিই তো–আর চিন্তার কি?
বটে! প্রাণ থেকে বলছিস?
প্রাণ মন আত্মা সব থেকে বলছি।
তবে বৃথাই লোকটা কাল থেকে অস্থির হয়ে বেড়াল?
একেবারে বৃথা।
দেখ সোনালী, তোর রকম-সকম রীতিমত সন্দেহজনক, বল পোড়ারমুখি কোথায় গিয়েছিলি?
এ জোর নীপা করতে পারে বটে। নীপা সোনালীর আবাল্যের সখী। নীপার কাছে কোনও দিন কোনও কথা গোপন করে নি সোনালী। এমন কি শশাঙ্কর ঔদাসীন্য অবহেলার কথাও।
নীপা অবশ্য বলে, অবহেলা নয়, ওকে বলে অন্যমনস্কতা, কিন্তু সোনালী তা বলে না।
কই, বললি না?
সোনালী ওর উগ্র কৌতূহলেভরা উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলে, পৃথিবীর বাইরে।
ভুরু কুঁচকে ওঠে নীপার।
তুই ভেবেছিস কি? কাল থেকে কি ঘোড়দৌড়টা করিয়েছিস আমাদের, তার ধারণা আছে? নিশ্চিন্ত ভেবে বসে আছি কোন চুলোয় কোন খানাখন্দরের ধারে হাত পা ভেঙে পড়ে আছিস, চোরে গায়ের গহনাগুলো খুলে নিয়ে গেছে
আহাহা, বলে যা বলে যা। শেয়ালে কুকুরে চোখনাকগুলো খুবলে খাচ্ছে! সত্যি, এত ভালবাসিস আমাকে যে কিছুতেই ভাবতে ইচ্ছে হল না, আমি বেশ আছি, খাসা আছি, নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছি, কেমন? ভালবাসার দাপটে আমার হাতভাঙা রক্তাক্ত কলেবর ছাড়া আর কিছুই তোর চোখে ভাসল না!
কথা দিয়ে কথা ঢাকিসনে সোনালী, এবার সত্যিই ভাবনা হচ্ছে আমার, কোথায় কী একটা করে এসেছিস তুই!
আমার ওপর তো তোর অগাধ আস্থা দেখছি।
আস্থা ছিল, সত্যিই ছিল। কিন্তু আর থাকছে না। মনে হচ্ছে পোড়ারমুখী তুই নিশ্চয় শশাঙ্কবাবুকে বোকা বুঝিয়ে নেমন্তন্নে যাচ্ছি বলে বেড়িয়ে অভিসারে গিয়েছিলি।
যাক এতক্ষণে রহস্য উদঘাটন করলি তাহলে?
আচ্ছা, এ রকম করছিস কেন বল তো? নীপা করুণ সুরে বলে, আমাকে না বলে পারবি তুই?
দেখি না চেষ্টা করে পারি কিনা।
কিন্তু তাতে তোর লাভ? বলতে বাধা কি? চেহারাখানি দেখে তো মনে হচ্ছে না বাপু অসহায়া রমণী কোনো দুৰ্বত্তের কবলে পড়েছিল, অথবা ডাকাতের কবলে। সাপ বাঘ নেকড়ে শেয়াল ধারে কাছেও আসে নি, অ্যাকসিডেন্ট তো নয়ই, তবে এই আঙুল গুনে সময় হিসেব করে বলে নীপা, আঠারোটি ঘণ্টা ছিলে কোথায়, করলে কি, তার হিসেব দিতে হবে না?
দিতেই হবে? সোনালী একটি দুর্ভেদ্য হাসি হেসে বলে, এত বড় এই জীবনটা থেকে মাত্র আঠারো ঘণ্টা সময় চুরি করে সরিয়ে রাখা যায় না?
নীপা এবার গম্ভীর হয়ে যায়, সোনালীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, নাঃ এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেস সিরিয়াস! অভিসারটা আর ঠাট্টার কথায় থাকছে না। কিন্তু আমার অগোচরে তলে তলে কবে কি করলি?
ভাবো বসে বসে। নিষ্কর্মা মাথা তবু খানিক কাজ পাবে।
উচ্ছন্নে যাও তুমি, গোল্লায় যাও। বলে রাগ করে উঠে যায় নীপা। যায় রান্নার তদারকে।
শুধু সোনালী নয়, আপ্যায়িত করতে হবে শশাঙ্ককেও। সহজে যাকে ধরে এনে খাওয়ানো দাওয়ানো যায় না। আজ বড় প্যাঁচে পড়েছেন বাছাধন, নীপা ভাবে, গিন্নিটিকে আটকেছি, ছুটে আসতেই হবে।
.
১৪.
কিন্তু আশ্চর্য, কিছুতেই কেন কোনো কথা বলছে না সোনালী! রহস্যকে জইয়ে রাখবারও তো একটা সীমা আছে। তবে কি শশাঙ্ককেই প্রথম বলতে চায়? নিশ্চয় এই নেমন্তন্নে আসা নিয়ে শশাঙ্কর সঙ্গে কিছু একটা ঘটেছিল, তাই রাগ করে কোথাও গিয়ে বসেছিল।
কিন্তু কোথায়?
সম্ভব অসম্ভব কোনো আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িই তো কাল থেকে খবর নেওয়া বাকী থাকে নি। আর নীপা বা শশাঙ্কর অজ্ঞাত কোথায় এমন আত্মীয় বন্ধু
.
চিন্তায় ছেদ পড়ল নীপার।
ফোন এসেছে।
করছে শশাঙ্ক। সবিনয়ে জানাচ্ছে মধ্যাহ্নভোেজনের নেমন্তন্ন নেবার সময় নেই তার। কিছু যেন মনে করে না সে আর সোনালী। ওই নেমন্তন্ন জিনিসটা ধাতে সয়ও না তার। সোনালী এসেছে, ভালো আছে, কোনো রকম বিপদ আপদ হয় নি, এটা যখন জেনেই যাওয়া গেল তখন আর শশাঙ্কর ব্যস্ততা কি? দুই সখী সারাদিন প্রেমালাপ চলুক। সন্ধ্যায় তো আসছে সোনালী নিজের বাড়ি।
নীপা বসে পড়ে। রেগে বলে, এই লোককে খোঁড়াই কেয়ার করে অভিসারেই যাওয়া উচিত তোর! ছি ছি, একটু ইয়ে নেই? কাল তো একেবারে মুখ-চোখ বসে শুকনো আমসি হয়ে উঠেছিল। আর যেই শুনলেন নিরাপদে ফিরেছে, হয়ে গেল সব উদ্বেগ ঠাণ্ডা? এই মুহূর্তে ছুটে আসতে ইচ্ছে হল না দেখবার জন্যে?
সোনালী শান্ত হাসি হেসে বলে, অবাক হবার কি আছে? ও তো ওই রকমই।
জানি না বাবা, রাগে ঝলসে ওঠে নীপা, এত সব রাঁধতে দিলাম ঘটা করে—
ভালোই তো। আমরা বেশি করে খাব।