ঠিক হয়ে গেছে! কথাটা হাতুড়ির ঘায়ের মত বুকের মধ্যে এমন করে বাজতে থাকে কেন?
সোনালী কি আশা করছিল ঠিক হবে না! এত সহজে ঠিক হবে না!
থেকে যেতে পারে সোনালী আরও কিছুক্ষণ। গ্রাম্য প্রকৃতি কি তার সরল সৌন্দর্যের ডালি হাতে নিয়ে দুর্নিবার আকর্ষণে টানছে সোনালীকে?
ঠিক হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
এত শীগগির?
বিশেষ কিছুই হয় নি। তবে তেলটা ফুরিয়েছিল।
আবার আশায় স্পন্দিত হয় বুক।
তবে? এখানে তেল জোগাড় করা তো খুব যেন চিন্তায় পড়েছে সোনালী।
না, ওটা একেবারে সংগ্রহ করেই আনলাম।
সংগ্রহ করেই আনলাম!
তার মানে যত শীগগির সম্ভব সোনালীকে বিতাড়ন করা!
হঠাৎ ভয়ানক একটা রাগ হয় সোনালীর। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে, এ সবের জন্যে টাকা বলে একটা জিনিসের তো দরকার হয়, যাবার সময় বলে গেলে পারতেন!
সুনেত্রা একটু অবাক হয়ে তাকান। এতক্ষণের সেই উজ্জ্বল উচ্ছল প্রাণচঞ্চল মেয়ের সহসা এমন রুদ্ররূপ কেন? ওই মুখের দিকে একবার তাকান সুনেত্রা দেবী, একবার নিজের ছেলের মুখের দিকে।
একটু স্তব্ধ হয়ে যান, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
কিন্তু ওই নিঃশব্দ প্রস্থান বুঝি এদের নজরে পড়ে না। ওরা শুধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েকটি মুহূর্ত।
তারপর নিরঞ্জন বলে, টাকা নেব বৈকি, শুধু টাকা কেন, আনা পাই সবই নিখুঁত হিসেব করে নিয়ে নেব।
তা তো নেবেনই। পাছে আর একটা বেলা আপনাদের অতিথি হতে চাই, তাই তাড়াবার জন্যে ব্যস্ততার সীমা নেই। মানুষ তো অতিথিকে একবার অফারও করে,–এ বেলাটা থেকে যান, এক মুঠো ভাত খেয়ে যান।
হয়তো করে। যে অতিথি সহজপ্রাপ্য, তাকে হয়তো করে। দুর্লভ অতিথির জন্যে কি সাধারণ ব্যবস্থা চলে?
ছাই দুর্লভ। কাল থেকে খালি জ্বালাতন করলাম।
দোহাই আপনার, ওই সাধারণ কথাগুলো থাক।
তবে কি বলব বলুন? সোনালী যেন হতাশ সুরে বলে, অসাধারণ কথার স্টক কোথায়?
নাই বা কথা হল। কথা সকলের মুখে মানায় না। নীরবতা অনেক বেশি অর্থবহ। কি কাজ কতকগুলো অর্থহীন কথায়, কি বলেন?
হেসে ওঠে নিরঞ্জন, চলুন। উঠবেন চলুন আপনার রথে। তারপর এই হতচ্ছাড়া দেশের হতভাগাদের চোখে ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে যান তাদের নাকের ওপর দিয়ে।
সোনালী অদ্ভুত এক রকম হেসে বলে, ধরুন যদি না যাই?
আহা। অপূর্ব!
ঠাট্টা করছেন? কিন্তু আপনাদের গ্রাম দেখে ইচ্ছে হচ্ছে থেকে যাই।
ওটা শহরবাসীদের প্রচলিত কথা। আবার স্বস্থানে ফিরে গেলেই মনে হবে, ই, অমন হতচ্ছাড়া দেশে মানুষ থাকে কি করে!
ওঃ, ওই কথাটা আর ভুলতে পারছেন না দেখছি।
নিরঞ্জনও বুঝি সোনালীর দেখাদেখি অদ্ভুত হাসি হাসতে শিখেছে। তাই সে হাসির সঙ্গে একটি বদ্ধ গভীর দৃষ্টি ফেলে বলে, সব কথা কি ভোলা যায়?
.
১৩.
না, সব কথা ভোলা যায় না।
সোনালী কি জীবনে কখনো ভুলতে পারবে এই জামতলা গ্রামকে?
শূন্য রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে ছুটে চলেছে সোনালী নতুন মেরামত করা নতুন তেল ভরা গাড়ি করে। গাড়িটার গতিতে উদ্দাম প্রাণের আবেগ।
যন্ত্র জিনিসটা সহসা বিকল হয়ে থেমে গেলেও ভয় নেই, আবার মেরামত করা যায়। আবার চালানো যায় তাকে সহজ পথে, নির্ভুল পথে।
সেই নির্ভুল পথ ধরে চলেছে সোনালী। যে পথে কাল সন্ধ্যায় যাবার কথা ছিল।
শুধু যে জিনিসটাকে সহজ পথে নির্ভুল পথে চালান নিজের হাতের বাইরে, সে চলেছে আপন খেয়ালে।
তাই বান্ধবী নীপার বাড়ি যাবার পথে সোনালীর আর মনে হচ্ছে না উপহারের জিনিস নেই তার হাতে।
একশো টাকার সেই নোটখানা ভাঙিয়ে গাড়ির তেলের দাম দিয়েছে সোনালী, দিয়েছে। মোটর মেকানিকের মজুরি, বাকী ফেরতটা নিয়েছে হাত পেতে নির্ভুল হিসেবে, তবু বারে বারে হিসেবের গরমিল হয়ে যাচ্ছে যেন।
আচ্ছা, আসার সময় সুনেত্রার কাছে কি তেমন করে বিদায় নেওয়া হয়েছিল? নাকি ত্রুটি থেকে গেল?
একটুখানি ব্যঙ্গহাসি ফুটে উঠবে না তো তার মুখে মেয়েটা কি অকৃতজ্ঞ ভেবে?
আর নিরঞ্জন? সুনেত্রার নেত্রের নিধি?
সে কী ভাবল সোনালীকে? বাঁচাল? বেহায়া? বেশি গায়ে-পড়া?
সোনালী বলেছিল, চলুন না আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। কত ট্রেন আছে ফেরবার।
কই আর কথা রাখল সে!
মৃদু হেসে বলল, কেন, এই তো বেশ দৃষ্টিপথ আচ্ছন্ন করে ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া।
.
না, কেউ বলে নি আবার আসবেন। বলে নি যাবেন ওখানে।
নীপা মিনিটখানেক স্তব্ধ থেকে ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলে, তুমি না তোমার প্রেতাত্মা?
যা বলিস।
চেহারাটি তো দেখছি একেবারে তাজা ঝকঝকে। চুলে একটু বিশৃঙ্খলা নেই, শাড়িতে নেই একবিন্দু ধুলো, মনে হচ্ছে সকালবেলা সাবান ঘষে মানও করে এসেছিস।
ধারণা ভুল নয়।
ভুল নয়?
না।
গিয়েছিলি কোথায়?
কোথাও না।
ন্যাকামি রাখ! অ্যাকসিডেন্ট যে ঘটে নি তা তো দেখা যাচ্ছে, গাড়ি আস্ত, তুই আস্ত, ব্যাপারটা কি?
ব্যাপার কিছুই না। কাল তোর নেমন্তন্নে এসে উঠতে পারি নি, আজ বাসি খেতে এলাম।
কোথায় গিয়েছিলি বলবি না?
কোথাও তো যাই নি, তা বলব কি?
আমার সঙ্গেও এ রকম চালাকি খেলবি? বেশ। কিন্তু গৃহকলহ যদি হয়েই থাকে, আমার সঙ্গে কি? আমার কাছে এলি না কেন?
গৃহকলহ? এ কথা কে বলল?
ভয় নেই, গৃহস্বামী নয়। আহা, বেচারার কি অবস্থা কাল থেকে! বোস, সব কথা শুনব পরে, আগে ওনাকে একটা খবর দিয়ে দিই। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল এক করে বেড়াচ্ছেন ভদ্রলোক।