নেবে না।
নিজের চেষ্টায় আর গ্রামের লোকের সহযোগিতায় যা পারবে করবে।
বাপ-ঠাকুরদার ভিটেটা ছিল তাই চলছে অনেক কিছু। স্কুল, তাঁতশালা, পোলট্রি।
গোড়ায় কি কম বেগ পেতে হয়েছিল? গ্রামের লোক বিশ্বাসই করতে চায় না। তাছাড়া শ্রমদানের মূল্য তো দূরের কথা, মানেই বোঝে না কেউ।
ছাড়া ছাড়া ছিটে ছিটে ভাবে মনে পড়ছে কথাগুলো।
.
খাওয়ার পর আবার সেই দালানে এসে বসেছিল খানিকক্ষণ। দেখছিল সুনেত্রার টেবিলের বই দুখানা উল্টে। না, গীতা নয়, ভাগবত নয়, যোগবাশিষ্ট রামায়ণও নয়, আধুনিক দুজন লেখকের দুখানা অতি আধুনিক উপন্যাস।
.
দেখে একটা সুস্থ হাওয়ায় হাঁপ ফেলে বেঁচেছিল সোনালী।
মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো লোকটার কি প্রাণে সাপের ভয়ও নেই?
ওই বিশ্রী জায়গায় সাপ বেরোতে পারে না রাত্রে?
এত বেপরোয়া কেন!
আশ্চর্য, কেউ তো ওকে বারণও করছে না।
কিন্তু কে করবে?
মা? মা কি সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে জেগে থাকতে পারেন?
আচ্ছা, সোনালী তো দেখছে। সোনালীর কি উচিত নয় ওকে সাবধান করে দেওয়া?
অনেকক্ষণ ধরে উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্ব চলল, তারপর তাকিয়ে দেখল দরজার দিকে। ও দরজাটায় নিষেধ, এ দরজাটা সুনেত্রার মাথার কাছে।
কোনটাই সহজ নয়।
কিন্তু সহজ হলেই কি সহজ হত?
অতএব এই জানলাই রইল শেষকথা। জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সোনালী।
কোনো এক সময় যেন নিশাচর মানুষটা কাঁটাবন ডিঙিয়ে জানলার কাছবরাবর এল, দাঁড়াল, চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, আবার চলে গেল।
জানলার নীচে দিয়ে চলে গেল। কথা বললে বলা অসম্ভব ছিল না, কিন্তু সাপের ভয়ের জন্যে সাবধান করা হল না।
অথচ যেত। একটু চেঁচিয়ে বললে অনায়াসেই শুনতে পেত লোকটা।
আরও কতক্ষণ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সোনালী।
তারপর কখন ঘুমে শরীর ভেঙে এল। কখন যেন শুয়ে পড়ল।
পরের বাড়িতে অচেনা জায়গায় ঘুম?
তা আসে বইকি। শ্বাসপ্রশ্বাসের গভীর শব্দ জানিয়ে দিচ্ছে সোনালী ঘুমিয়ে পড়েছে।
.
১২.
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়।
সুনেত্রার ডাকে। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে মৃদু ডাক দিচ্ছেন তিনি।
কী আশ্চর্য, আপনি! না না, ছি ছি, আমায় একটু আগে ডেকে দিলেন না কেন? আমি তৈরি করতাম চা।
সুনেত্রা হেসে উঠলেন, আমাদের চা-টা কোরো তৈরি, এখন খেয়ে নাও। তোমরা বাছা শহরের মানুষ, নিশ্চয় বেড-টি খাওয়া অভ্যেস।
না না, ওসব কিছু না। লজ্জিতভাবে বলে সোনালী।
তা আজ একদিনই নয় খাও। সুনেত্রা সামনে একটা টুলে বসে বলেন, এ শহুরে অভ্যেসটুকু আমারও আগে ছিল, কিন্তু গ্রামে বাস করতে করতে কখন যে সে অভ্যেস ঝরে পড়ল টেরও পেলাম না। কত অভ্যেসই এমন ঝরলো।
আগে বুঝি কলকাতায় থাকতেন? সোৎসুকে প্রশ্ন করে সোনালী।
না কলকাতায় নয়, ওদিকে। সুনেত্রা বুঝি একটা নিঃশ্বাস চেপে নিয়ে বলেন, নিরুর বাবার কাজ ছিল দিল্লী সিমলে, মানমর্যাদা বজায় রাখবার জন্যে ক্লেশ কত! হাসলেন সুনেত্রা, নিজের হাতে নিজের সংসারের কাজকর্ম করব তার জো নেই। হামেহাল নাকের সামনে চাকর খাড়া। কি আর করবে তারা, বারকতক চা-ই খাওয়াতো সেধে সেধে ডেকে ডেকে।
স্তব্ধ হয়ে যায় সোনালী। এই সহজ কথাটুকুর মধ্যেকার প্রচ্ছন্ন ইতিহাসখানি অনুভব করে।
আর যখন চেতনা হয়, তখন সমস্ত অন্তরাত্মা আর একবার ছি-ছি করে ওঠে নিজের গত সন্ধ্যার আচরণ স্মরণ করে।
আপনাদের চা খাওয়া হয় নি?
বোধকরি নীরবতা ভঙ্গ করতেই এই বাহুল্য প্রশ্ন।
না, নিরু তো সেই কোন ভোরে বেরিয়ে গেছে। ফণীও গোয়ালের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, নিরু আসুক।
কোথায় গেছেন?
যেন কোনো ঔৎসুক্য নেই, নেই কোনো আগ্রহ, শুধু একটু সাধারণ কথা।
সুনেত্রা বলেন, ওই যে সেই মোটর মেকানিকের সন্ধানে। সাড়ে সাতটা থেকে যত সব বাস লরি ছাড়তে থাকবে, মিস্ত্রিগুলো তখন কাজে আটকা পড়ে যায়, তার আগেই যাতে–
আমার জন্যে আপনাদের কত বিব্রত হতে হল!
এর আবার বিব্রত কি মা? সুনেত্রা প্রসন্নমুখে বলেন, আমার ক্ষ্যাপা ছেলে এটুকুতে বিব্রত বোধ করে না। ওই করতেই তো আছে। কারুর একটু কাজে লাগতে পারলে–তা ছাড়া যদি বিব্রতই বলল, হাসেন সুনেত্রা, তার বদলে কতখানি লাভ হল আমাদের বলো তো?
লাভ!
লাভ বইকি! তোমার মত এমন একটি মেয়ে পাওয়া কি কম লাভ মা?
হয়তো জীবনে আর আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না।
যেমন গভীর স্বরে জীবনে কোনো দিন বলে নি সোনালী, হয়তো যে গভীরতর স্তরের সন্ধানও জানত না কোনো দিন, সেই গভীর স্বরে কথা বলে সোনালী। সেই গভীরতর স্তর থেকে উঠে আসে একটি ভারী নিঃশ্বাস।
সুনেত্রা বৃথা হইহই করেন না, না না সে কি, আবার দেখা হবে বইকি, বলে স্তোক না দিয়ে শুধু তিনিও গভীর স্বরে বলেন, হয়তো হবে না। তবু এই পাওয়ার জমাটুকু তো রইল। আমার ঘরে এমন মেয়ে তো জীবনে কখনো আসবে না।
এই আক্ষেপটুকুর মধ্যে রইল অনেকটা কথা। অনুক্তর মধ্যে উক্ত হল বাংলা মাতৃমনের আশা আর হতাশা।
আদর্শবাদী সন্তানের মা হওয়া গৌরবের নিশ্চয়, কিন্তু গৌরবের মধ্যে তো লুকিয়ে থাকে দুঃখ।
সাধারণ হতে না পারার দুঃখ, সহজ হতে না পারার দুঃখ।
.
সকালের আলোয় সুনেত্রার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখল সোনালী-সুনেত্রার ক্ষেতখামার, ফুলবাগান, নিরঞ্জনের স্কুল, তাঁতশালা।
তারপর এল নিরঞ্জন।
ঠিক হয়ে গেছে আপনার গাড়ি।