লজ্জার কি আছে? চাষাভূষোর মত চেহারা নিয়ে দাঁড়ালে লোকে আর কি ভাববে তাকে? আমার তো মজাই লাগছিল।
মজা! আমি হলে কিন্তু রেগে আগুন হতাম।
সেটা অনুমান করছি।
অনুমান করছেন? কি করে?
সব বিষয়ে অগ্নিশিখার সাদৃশ্য দেখে।
চমকে মুখ তুলে তাকায় সোনালী, তারপর তীক্ষ্ণস্বরে বলে, এ ভাবে প্রশস্তি গাওয়াটা বুঝি আপনার অভ্যস্ত বিদ্যা?
না, কোনো দিন না। নিরঞ্জন গাঢ়স্বরে বলে, এইমাত্র দেখছি বিদ্যাটা আপনিই এসে যাচ্ছে।
কেন?
কি জানি। খুব বেশি অভাবনীয় একটা কিছু ঘটল বলে বোধ হয়। সত্যি স্বপ্নের মধ্যেও এতটা অভাবনীয়তা কল্পনা করা যায় না। আপনার আজকের এই দুর্বিপাক আমার কাছে
কি আপনার কাছে?
কিছু না এমনি।
সহসা দুজনেই কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়।
কে জানে কতক্ষণ ছিল দুজনে পরস্পরের দিকে না তাকিয়ে, অথচ কাছাকাছি বসে।
ফণী এসে ডাক দিল, দাদাবাবু, দিদিমণি, মা ডাকছেন।
চলুন।
চলুন!
সহসা অনুভব করে সোনালী, খিদেও পেয়েছে বটে।
ভিতর বাড়িতে নিয়ে যায় ফণী আলো ধরে ধরে।
দেয়াল ভাঙা ভাঙা, কিন্তু মেজেটা পরিষ্কার। নিকানো মাজা মাজা উঠোন, ধারে ধারে ফুলগাছের সারি, ঝিরঝিরে বাতাস, জানা-অজানা নানা ফুলের গন্ধে সে বাতাস অলস আবেশময়।
এই বাতাসে সমস্ত চপলতা স্তব্ধ হয়ে যায়, সমস্ত বাঁচালতা মূক হয়ে যায়। বাড়িটা নতুন চকচকে হলেই বুঝি এই ছন্দে ছন্দপতন হতো।
.
কোথায় যেন চলে এসেছে সোনালী। কোনো পূর্বজন্মের অতীতে। কি যেন এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ধরা-অধরার লুকোচুরি খেলায় উতলা করে তুলছে তাকে। সোনালী কি কিছু হারিয়ে ফেলেছে? সোনালী কি হঠাৎ কিছু পেয়েছে?
৩. শোবার ঘরে
১১.
খাওয়ার পর সুনেত্রা দেবী নিয়ে এলেন সোনালীকে শোবার ঘরে।
দালানের সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঘর, দালানের যেদিকে সুনেত্রার নিজের চৌকী পাতা সেদিকে। হাত বাড়ালে দরজায় হাত ঠেকে।
বলতে গেলে একই ঘর, বললেন সুনেত্রা, নির্ভয়ে শোও তুমি, এই পর্দাটা টানা রইল, ইচ্ছে করলে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে পারো। ওদিকে আর একটা দরজা আছে, সেদিকটা ভাঙা–সে দরজা খোলা যায় না। এই পাখা রইল, এই খাবার জল, শুয়ে পড়ো।
.
সুনেত্রা চলে আসতেই দরজাটা সোনালী বন্ধ করেই দিল। নিভিয়ে দিল টেবিলে বসানো বাতিদানের জ্বলন্ত বাতিটা। খুলে দিল সমস্ত জানলা।
ছোট্ট ঘর হলে হবে কিসব দেওয়ালে দেওয়ালজোড়া জানলা, সবগুলো খুলে দিতেই জ্যোৎস্নায় ভরে গেল ঘরখানা।
এখানেও একহারা একখানা চৌকীতে পরিপাটি একটি বিছানা। মাথার কাছে টেবিল। টেবিলে বাতিদান, ফুলদানী।
পোড়ামাটির গায়েয় ছাঁচের কাজ করা সুন্দর ফুলদানী। তাতে কয়েকটি চাঁপা ফুল।
রুচি আছে এদের। মনে মনে বলল সোনালী।
বলল কেমন যেন আবিষ্টের মত ভোলা জানলার দিকে তাকিয়ে বসে।
আজ সন্ধ্যা থেকে যা কিছু ঘটছে তা পর্যালোচনা করতে পারলে হয় তো সোনালী মনস্তত্ত্বের নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারত।
সব কেমন ঝাপসা লাগছে।
এ সব কি সত্য? এই ঘর, এই বিছানা, ওই জানলা আর জানলার বাইরের ঝিঁঝি ডাকা অন্ধকার, এ সব কি বাস্তব, না স্বপ্ন?
আর সোনালী নিজে?
সব কেমন ঝাপসা লাগছে।
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি কবে কজনের ভাগ্যে ঘটে?
এই একটু আগে সেই ফুলের গন্ধে উতলা বাতাসে ভোলা বোয়াকে পিঁড়ি পেতে বসে খেয়ে এল যে মানুষটা, সে কে?
যখন খেয়েছিল তখন কি প্রকৃতিস্থ ছিল? ছিল আত্মস্থ?
তবে কেন কিছুই মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে না কি খেয়েছিল, কি বা কথা বলেছিল।
অথচ এটা মনে পড়ছে বলেছিল কথা, হয়তো খেয়েও ছিল সবই, যা কিছু পরিবেশন করেছিলেন সুনেত্রা।
নেশাচ্ছন্নের মত সমস্ত চৈতন্য যেন কুয়াসাটাকা। অথচ ঘুমও আসছে না। পরের বাড়িতে অচেনা বিছানায় ঘুম কি আসে?
এ ঘরটা কার শোবার ঘর?
চারিদিক তাকিয়ে দেখল সোনালী মোমবাতির মৃদু আলোয়। বিছানা আর টেবিল বাদে আর বিশেষ কিছুই নেই। কেমন যেন রিক্ত রিক্ত চেহারা। কোনো মানুষের স্থায়ী উপস্থিতির চিহ্ন বহন করছে না।
বোধকরি এ ঘর কারুরই শোবার ঘর নয়। অতিথির জন্যে প্রস্তুত থাকে। থাকে সরু খাটে বিছানা পাতা।
.
কৃষ্ণপক্ষের রাত।
যত রাত গম্ভীর হচ্ছে চাঁদ ততই উজ্জ্বল হচ্ছে। জানলার বাইরের ঝোঁপজঙ্গলগুলো এখন আর জমাট অন্ধকারের চাপ বলে মনে হচ্ছে না। ছাড়া ছাড়া ভাবে দেখা যাচ্ছে।
জানলার ধারে এসে দাঁড়াল সোনালী।
ঠাণ্ডা একটা বাতাসের শিহরণ।
কিন্তু ও কি?
ঠাণ্ডা বাতাসের শিহরণের চাইতে অনেক তীব্র বিদ্যুতের মত একটা শিহরণ খেলে গেল সর্বাঙ্গে।
ওখানে, ওই মাঠের মাঝখানে এত রাত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে?
কী দরকার ওর এমন করে ঘুরে বেড়াবার খালিগায়ে জ্যোৎস্নার প্রলেপ মেখে!
বিশ্বাস করুন, ছদ্মবেশ নয়, ওটাই আমার স্বাভাবিক বেশ, সচরাচরের বেশ।
হ্যাঁ, বিশ্বাস করেছে সোনালী।
বিশ্বাস করে মুগ্ধ হয়ে বলেছে, এমন বলিষ্ঠ পুরুষদেহের এই বেশই স্বাভাবিক হওয়া উচিত।
কিন্তু ও জেগে কেন?
ও ঘর ছেড়ে বাইরে কেন?
.
আস্তে আস্তে তখনকার কিছু কিছু কথা মনে পড়ছে।
সুনেত্রা তার ছেলের গুণের কথা গল্প করছিলেন তখন।
একরাশ পাশ করে, দেশ-বিদেশ থেকে বিদ্যে আহরণ করে ছেলে ওঁর এখন গ্রাম সেবা নিয়ে মেতে আছে, এই কথাটাই বোঝাচ্ছিলেন তিনি।
বলেছিলেন, তাই কি গভর্নমেন্টের সাহায্য নেবে?