ওই লোকটা নয় তো? ছদ্মবেশী কোনো দলনেতা হতে পারে,–বিশ্বাস কি?
বোসো মা।
মহিলাটির কণ্ঠস্বরে দালানের এ পাশটায় লক্ষ্য পড়লো। এ পাশে দেয়াল জুড়ে সরু টানা একটা চৌকী, আশেপাশে কয়েকটি বেতের মোড়া। এই দিকে সোনালীকে বসতে অনুরোধ করছে মহিলাটি।
চৌকীতে বসল সোনালী।
দেখলো তার ওপর বিছানো চাদরটা ছাপা খদ্দরের। সামনের বিছানার চাদরটাও বোধকরি তাই। এতক্ষণে নজর পড়ল মহিলাটি এবং পুরুষ দুটি তিনজনেই খদ্দরমণ্ডিত।
ওঃ, বোঝা গেছে।
এতক্ষণে যেন কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয় সোনালী। রাজনৈতিক দল হতে পারে। কিন্তু ভয়ঙ্কর কোনো দল নয়।
মহিলাটি যে রীতিমত অভিজাত ঘরের তাতে আর সন্দেহ নেই, চলনে বলনে ধরনে চেহারায় বনেদী আভিজাত্যের ছাপ।
আর এই লোকটা?
স্পষ্ট আলোয় ধরা পড়ছে এবার মহিলাটির সঙ্গে একান্ত সাদৃশ্য। তার মানে লোকটা ওঁর আপন কেউ। অর্থাৎ ভদ্রলোক।
কিন্তু কী ভয়ঙ্কর লোক! এ ভাবে ছোটলোকের ছদ্মবেশে
নিরু, তুই তাহলে চেষ্টা দেখ এঁর জন্যে কি করতে পারিস। অভিজাতের মসৃণ কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে ওঠে, আমি ততক্ষণ এঁকে-হাতমুখ ধোবে মা?
সোনালী বিচলিত ভাবে বলে, না না, ওসব কিছু দরকার নেই।
মহিলাটি তাকিয়ে দেখেন।
তা সত্যি, দরকার নেই সত্যিই। এনামেলমণ্ডিত উগ্র আধুনিক সাজের এনামেলটা এত উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, এত ঘাম গরম সব কিছুর মধ্যেও যথেষ্ট বজায় রয়েছে। অতিরঞ্জিত ঠোঁটটাই যা আপাতত ঈষৎ ম্লান।
তাহলে থাক। কিন্তু খেতে তো হবে একটু।
না না, আমার কিছু খাবার ইচ্ছে নেই এখন।
তা বললে কি ছাড়ব মা, এখন ছাড়া তোমাকে আর পাচ্ছি কোথায়? সকাল হলে আর কি তুমি আমার ঘরে
সকাল হলে! সোনালী চমকে বলে, রাত্তিরে এখানেই থাকতে হবে নাকি?
মহিলাটি ওর চমকানিতে হেসে ফেললেন, তা এই রাতে আর এই ঝোপজঙ্গলের পথে কোথায় যাবে মা? কি করেই বা যাবে?
কেন, আপনি যে বললেন উনি কি যেন ব্যবস্থা করবেন।
নিরু নামক ব্যক্তিটিকে এবার উনি সম্বোধনে সম্ভ্রম দেখায় সোনালী।
ভেবেচিন্তে নয়, অজ্ঞাতসারে।
মহিলাটি নিরুর দিকে একবার তাকিয়ে আর একটু হেসে বলেন, এই রাতে তোমার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা আর কি করে হবে মা? কলকাতা থেকে কত দূরে এসে পড়েছ। এখন কলকাতা থেকে গাড়ি আনিয়ে আবার সেখানে ফিরে যেতেও তো রাত ভোরই হয়ে যাবে। ব্যবস্থা করতে বলছি–তোমার বাড়িতে খবর দেবার। বাড়িতে সবাই ভাবছেন তো
সবাই ভাবছেন তো, এইটুকু বলেই থেমে গেলেন ভদ্রমহিলা।
সোনালী কোথায় যাচ্ছিল, কেন যাচ্ছিল এতদূর পথে রাতে অমন একবস্ত্রে, একলাই বা যাচ্ছিল কেন, এ সব অশিষ্ট প্রশ্নের দিক দিয়েও গেলেন না।
এমন কি নারীর সহজাত কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে দেখলেন না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
এই যে সোনালী বললে হাত মুখ ধোবার দরকার নেই, তৎক্ষণাৎ সেই অপ্রয়োজনের ইচ্ছাটাকেই মেনে নিলেন, তার ওপর জোর করলেন না অনুরোধে ভেঙে পড়ে।
সোনালী যদি খেতে না চায়, যদি বলে দরকার নেই, নিশ্চয় মেনে নেবেন সে কথা। খাও খাও করে পীড়ন করবেন না।
আতিশয্য কিছুতেই নেই।
এমন কি চাকরটা পর্যন্ত এত শিক্ষিত যে, মনের বিরক্তি স্পষ্ট প্রকাশ করে নি। তবে চটেছে যে বিলক্ষণ তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু মনিবের মান রেখে চলতে চুপ করে আছে।
নাঃ, এদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই সোনালীর।
যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হয় সোনালী।
না, সত্যিই ভদ্র রুচির মানুষ।
মা, আমি বেরুচ্ছি তাহলে– বলে নিরু (খুব সম্ভব নিরঞ্জন) দালানের মধ্যেকার একটা দরজা দিয়ে কোন ভিতরে চলে যায় এবং মিনিট খানেক পরেই গায়ে একটা মোটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে বেরিয়ে আসে।
একটু সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলে, জানি না আমার অভিযান সফল হবে কিনা, না হবার আশঙ্কাই পনেরো আনা, বাকী এক আনার উপর নির্ভর। তবু চেষ্টা করব। দয়া করে আপনার ফোন নাম্বারটা—
.
০৯.
ফোন নাম্বার!
মুহূর্তে সোনালী অনেকগুলো মাইল অতিক্রম করে পৌঁছে যায় একটা পরিচিত বাড়ির দোতলার একটা ঘরে।
যেখানে টেবিলল্যাম্পের সামনে টেবিলের উপর ঝুঁকে বসে এক জ্ঞানতপস্বী।
সেই টেবিলের ধারে উঁচু টুলের উপর বসানো আছে টেলিফোন রিসিভারটা।
টেলিফোনের কল লোকটার সমাধির মধ্যে সহজে সাড়া জাগাতে পারে না। বার বার চেঁচাতে চেঁচাতে তবে সমর্থ হয় তার ধ্যানভঙ্গ করতে।
সোনালী দেখতে পায় অলস হাতে রিসিভারটা তুলে নিয়েছে সে। তারপর এ পক্ষের বক্তব্য শুনে অবাক-অবাক গলায় বলছে, তাই নাকি? এতক্ষণ ফেরেন নি উনি? জানতাম না তো! আচ্ছা ঠিক আছে, আছেন তো কোথাও এক জায়গায়।…কী বললেন? ব্যাপারটা হয়েছে গাড়ি বিগড়ে? ওঃ। আচ্ছা কাল সকালে যা হয় হবে। ধন্যবাদ, ছাড়লাম।
এ ছাড়া আবার কি! আর কিছু নয়।
এই এরা, এরা মনে মনে কত হাসবে! ভাববে, ওঃ মহিলাটির তো এ দিকে এত অহংকার, অথচ দেখছি ঘরে ওঁর কোনো মূল্যই নেই।
হঠাৎ অকারণ একটা রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে সোনালীর। থাক দরকার নেই খবর দেবার। কী কাজ, যার উদ্বেগ নেই তার উদ্বেগ মোচনের চেষ্টায়।
চেয়ে দেখে সামনের ব্যক্তিটির দিকে।
পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে চেহারায় এসে গেছে ভদ্র ছাপ। সন্দেহ নেই ও এতক্ষণ ধরে প্রতারণা করেছে সোনালীর সঙ্গে।
ওই ফণীটার সঙ্গে এক শ্রেণীভুক্ত করে ওকে তুমি বলেছে সোনালী, বকেছে ধমকেছে, কোনো প্রতিবাদ করে নি ও।