তা জানি। আপনার কাছে তো নেয্য কথা কইবার জো নেই।
ফণীর দাদাবাবু সম্বোধনটা সোনালীকে একটু যে নার্ভাস করে না আনে তা নয়। বোঝা যাচ্ছে আর যাই হোক, এ লোকটা ফণীর পর্যায়ভুক্ত নয়। কিন্তু এখন আর কি-ই বা করা যায়। বড় জোর সুরটা একটু নরম করা। কিন্তু তাতেও তো মানের হানি। ও যা হচ্ছে তোক।
অতএব সুরের গরমটা একটু কমলো কি না কমলো, নরম আদৌ নয়।
আচ্ছা মানছি, আমারই সব দোষ। কিন্তু কি করে জানব যে পৃথিবীতে এখনও এ রকম হতচ্ছাড়া জায়গা আছে।
পৃথিবীতে যে এখনও আরও কত হতচ্ছাড়া জায়গা আছে সে আপনাদের কল্পনার শুধু বাইরেই নয়, তার থেকে সমুদ্রপ্রমাণ দূরে।
.
০৭.
গম্ভীর মৃদু ক্ষুব্ধ এই স্বরটা যেন শুধু সোনালীকেই নয়, সমস্ত সভ্যতাকেই ধিক্কার দিয়ে উঠল।
সোনালী যদি আজকের বিকেল থেকে এই রাত অবধি সমস্ত ঘটনাটা জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারত!
আবার দেখা দিচ্ছে আপনি তুমির দ্বন্দ্ব। লোকটার কথাবার্তা বারে বারেই ধাক্কা দিচ্ছে সোনালীকে।
বিমূঢ়র মত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সোনালী বলে, তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে–এখন আমার সারারাত এই অবস্থায় বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করবার নেই! বাঘেই খাক আর ডাকাতেই ধরুক।
অত দূর পর্যন্ত নয়! একটু কষ্ট করে খানিকটা হেঁটে গ্রামের মধ্যে চলুন, আপনাকে বসিয়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
গ্রামের মধ্যে কোথায় আমি বসতে যাব? উদ্বিগ্ন স্বর সোনালীর।
এই হতচ্ছাড়া গ্রামের কোনও এক হতভাগ্যের ঘরে।
তারপর? ব্যবস্থাটা কি হবে?
দেখি যদি স্টেশন থেকে ফোন–ফোন আছে অবশ্যই আপনার বাড়িতে?
ফোন! সোনালী যেন অথৈ সমুদ্রের কূল পায়। কী আশ্চর্য, এতক্ষণ এই সহজ কথাটা মনে আসছিল না কেন তার?
ফোন আছে বইকি! এখানে ফোন আছে কারুর বাড়ি?
এখানে? লোকটা কেবলই বুঝি হাসির খোরাক পাচ্ছে, এখানে নয়। স্টেশন থেকেই যদি সম্ভব হয়। তাও নিশ্চয় করে বলতে পারছি না। তবে চেষ্টা দেখতে হবে তো। বাড়িতে অবশ্যই সবাই ভাবছেন।
আমার জন্যে ভাববার কেউ নেই। সহসা বলে ওঠে সোনালী।
লোকটার কি একটু বিস্ময় বোধ হয় না? একটু বা কৌতূহল?
মনে হয় না ভদ্রমহিলা কি রাগ করে বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলেন না কি?
কিন্তু কৌতূহল প্রকাশটা অশোভন। তাই একেবারে প্রসঙ্গান্তরে চলে যায় সে, তাহলে নেমে এসে হাঁটুন একটু কষ্ট করে। ফণী, তুই আলোটা নিয়ে আগে আগে চল্।
নেমে পড়বার ইচ্ছে অনেকক্ষণ থেকেই করছিল সোনালীর, কিন্তু ঠিক সাহস পাচ্ছিল না। গাড়ির মধ্যে আছে তবু নিজের কোটে আছে।
আহা, গাড়িটা যদি সহসা বিশ্বাসঘাতকতা পরিহার করে! যদি স্টার্ট দিতেই স্টার্ট নিয়ে ছুটতে শুরু করে। তাহলে ওদের নাকের সামনে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় সোনালী ধুলোর ঝড় উড়িয়ে।
কিন্তু যেত কি?
সত্যি বলতে কি, খুব ভয়ঙ্কর ভয় আর করছে না!
আর এই মুহূর্তে সমস্ত নাটকটার উপর যবনিকাপাত করে ঠিক যে চলেই যেতে ইচ্ছে করছে তাও নয়।
নিজেকে সাংঘাতিক বিপদগ্রস্ত আর মনে হচ্ছে না, বরং অনেকটা যেন উপন্যাসের নায়িকার মত মনে হচ্ছে নিজেকে।
এই জায়গাটাকে কি যেন বললে?
জামতলা।
এইখানে থাকো তোমরা?
হ্যাঁ।
কেন, টাউনে থাকতে পারো না? এখানে এত অসুবিধে
ফণী হেসে ওঠে, গাঁয়ের মানুষদের অসুবিধেয় অত কাতর হলে চলে না। হয়ও না।
খাও কি? এখানে নিশ্চয়ই বাজার নেই!
সবই আছে।
কথা কইবার জন্যেই কথা কইছে সোনালী। নিঃশব্দে নিয়তির নির্দেশে এগিয়ে চলার মত লোক দুটোর পিছন পিছন এগিয়ে যেতে ভালো লাগছে না।
কথা কওয়া ভালো, কথার মধ্যে আশ্রয় আছে। তবু গেল খানিকক্ষণ।
ফণীর হাতের আলোর রেখাটুকু ধরে নীরবে এগিয়ে চলেছে দুটো মানুষ।
প্রথমজন সোনালী, দ্বিতীয়জন এখনও অজ্ঞাতনামা।
তা সোনালীর নামটাই কি ও জেনেছে?
.
আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে সেই কোনো একজন যেন হতভাগ্যের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোবার জন্যে?
এ লোকটার সঙ্গে নেহাৎ ফণীর মত করে কথা না বললেও চলবে এটুকু বোঝা গেছে এতক্ষণে।
উদ্দিষ্টব্যক্তি হেসে ওঠে।
এই যে প্রায় এসে গেছি।
তোমারই বাড়ি বোধহয়? নাকি তোমার মনিববাড়ি?
নাঃ, ফণীর সহ্যের উপর বড্ড বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে, আর পারছে না সে। দাদাবাবুর এই অতাত ভাবে গা জ্বলে যাচ্ছে তার।
কোথা থেকে এক উড়ো আপদ এসে জুটে কী গেরো করছে।
বেশ বাবা, একা মেয়েছেলে বেরিয়ে পড়ে পথে বিপদে পড়েছিস, মায়া দয়া করা মানুষের কাজ। আর দাদাবাবুর তো ওই পেশা, লোকের উপকার করে বেড়ানো, লোককে মায়া দয়া করে।
করো ভালো কথা, কিন্তু ওই বেসহবৎ মেয়েটা যে তোমায় চাকরবাকরের মত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে, এটা বরদাস্ত করবার দরকার কি?
অথচ এটা ফণীর বিলক্ষণ জানা, ফণী যদি মেয়েটাকে দাদাবাবুর মহিমা সমঝে দিতে যায়, জন্মে আর ফণীর মুখ দেখবে না দাদাবাবু।
রাগের চোখে শুধু হাতের আলোটাকে সজোরে আন্দোলিত করতে থাকে সে চলতে চলতে।
ফণী, আলোটা নিভে যাবে, আস্তে। …হ্যাঁ কি বললেন, বাড়িটা আমার মনিববাড়ি কিনা? তা প্রায় ঠিকই ধরেছেন। ওটাই আমার কর্মস্থল।
হুঁ।
কোনো এক রহস্য আবিষ্কারের আশায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে সোনালীর।
কি কাজ করতে হয়?
যখন যা পড়ে। যখন যা এসে যায়। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত।
আর এই ফণী?
ও? ও আমার সহকারী।
বাড়িতে আছে কে?