- বইয়ের নামঃ একটি সন্ধ্যা একটি সকাল
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
১. ছুরিটা এসে বিধলো
একটি সন্ধ্যা একটি সকাল – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
০১.
ছুরিটা এসে প্রথম বিধলো ডান দিকের রগে।
তীক্ষ্ণ চকচকে ধারালো।
মাথাটা একটু সরিয়ে নিলো শশাঙ্ক। তবু কানের গোড়াটায় বিধতেই লাগল। এবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেলল প্রায় টেবিলের কাছবরাবর। হাতের বইটার থেকে আধ ফুট মাত্র ব্যবধান থাকল।
পড়ার একটু অসুবিধে হচ্ছে, তা হোক, তবু নড়েচড়ে উঠে গিয়ে আক্রমণের পথটা বন্ধ করার কথা মনে আনছে না শশাঙ্ক।
কিন্তু মাথা হেঁট করেই কি সব সময় নিস্তার পাওয়া যায়? এ ক্ষেত্রে অন্তত যাচ্ছে না, ছুরিটা এবার এসে শশাঙ্কর হাতের বইয়ের পাতাটাই বিধছে। সমস্ত অক্ষরগুলো আলোয় আঁ আঁ করে উঠলে পড়া চলে না।
শশাঙ্কর মনে হল পশ্চিমের জানলা দিয়ে আসা পড়ন্ত বেলার ওই রোদের ছুরিটা ঠিক যেন একটা জ্বালাতুনে মানুষের মত ব্যবহার করছে। একটু নিশ্চিন্ত শান্তিতে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে দেবে না। শশাঙ্কর এই নিরুপায়তাটা হাস্যকর অর্থহীন।
ইচ্ছে করলেই এখুনি উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দেওয়া যায়। উঠতে ইচ্ছে না করলে চাকরদের কাউকে ডেকে বন্ধ করে দেবার হুকুম দেওয়া যায়। চেয়ারটাকে খানিকটা টেনে নিয়ে সরে বসা যায়।
কিন্তু সে-সবের কিছুই না করে শশাঙ্ক বই থেকে চোখ তুলে ওই পশ্চিমের জানলাটার দিকেই রুক্ষ দৃষ্টি হেনে বসে বসে ভাবতে লাগল।
জীবনে সে এর বেশি কিছুই চায় নি। একটি নিরুপদ্রব কোণ, আর নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ একটু অবসরের শান্তি। শুধু এইটুকু পেলেই সারা জীবন কেটে যেতে পারত আনন্দরসের সমুদ্রে তলিয়ে থেকে!
পৃথিবীতে কত বই!
কত ভালো ভালো বই! একটা জীবনে পড়ে ফুরোবার নয়। বইগুলো আয়ত্ত করতে যদি নতুন নতুন ভাষার চাবি হস্তগত করতে হয়, তাতে তো আরও আনন্দ, আরও রোমাঞ্চ!
কিন্তু কোথায় সেই দুর্লভ অবকাশ! কোথায় সেই নিরুদ্বেগ নিশ্চিন্ত!
এই পড়ন্ত রোদটা যেমন রগে কপালে কানে বইয়ের পাতায় পর্যন্ত এসে বিধে উত্ত্যক্ত করছে, সারা জীবনই কে যেন এমনি করে উত্ত্যক্ত করছে শশাঙ্ককে।
.
ছেলেবেলায়?
তখন তীব্র আকর্ষণ ছিল গল্পের বইয়ে।
কিন্তু তাতে কী তীব্র বিরোধিতা ছিল বাবার! ছেলের হাতে অথবা তার টেবিলে শেলফে বালিশের তলায় গল্পের বই দেখেছেন কি হুঙ্কার দিয়ে কেড়ে নিয়েছেন। হয়তো বা শুধু কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হন নি, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, পরের বই বলে মানেন নি।
শশাঙ্কর মা এ নিয়ে মৃদু প্রতিবাদ করলে সদর্পে বলেছেন, এই ঠিক করলাম, জন্মের শোধ শিক্ষা হয়ে যাবে। একে কতকগুলো রাবিশ গেলার বদভ্যাস, তার ওপর আবার পরের কাছে চেয়ে ভিক্ষে করে আনার বদভ্যাস! দুটোই সমান খারাপ, এই রকম জব্দ হলেই তবে ওই অভ্যেস ছাড়বে।
কিন্তু না। বাবার শত চেষ্টাতেও সে অভ্যাসটা ছাড়ে নি শশাঙ্ককে। উত্তরোত্তর গ্রাসই করেছে তাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যতালিকার গতি বদলেছে, কিন্তু মনের গতি বদলায় নি। অধ্যাপনা তার পেশা, কিন্তু অধ্যয়ন তার শুধু নেশাই নয়, আরও অনেক কিছু।
এইটাই টের পেয়ে ফেলেছে বলেই বুঝি সোনালীরও শশাঙ্কর এই গ্রন্থজগার ওপর এত আক্রোশ! কিন্তু সোনালীর আক্রোশ শশাঙ্কর বাবার মত তীব্র বিরোধিতার বেশে দেখা দেয় না, দেখা দেয় ব্যঙ্গ আর অবজ্ঞার মূর্তিতে।
শশাঙ্ককে সে বইপোকা বলে সম্বোধন করে। কৌতুকের হাসি দিয়ে নয়, তিক্ত রসাস্বাদিত ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে।
এমনিতেই সোনালীর ঠোঁটের গড়নটাই যেন ঈষৎ বাঁকারেখায় রহস্যময়, তার উপর
আঃ, রোদটা ভেবেছে কী! যাবার আগে মরণকামড় দিয়ে যেতে চাইছে বুঝি! নইলে আবার কোন কোণাচে পথ দিয়ে ফের এসে বা রগটায় বিধছে!
আশ্চর্য! এই এতক্ষণের মধ্যে বাড়ির কারুর কি একবার এ ঘরে আসতে নেই? একটা চাকরবাকর কিংবা…না, সোনালীর কথা ভাবছে না শশাঙ্ক, ভাববার প্রশ্ন ওঠে না। সোনালী এতক্ষণে তার টেনিস র্যাকেট ঘোরাতে ঘোরাতে কখন নেমে গেছে, কখন চলে গেছে নিজে হাতে ড্রাইভ করে।
হ্যাঁ, বিকেলে খেলতে যাবার সময় কি বেড়াতে যাবার সময় নিজেই ড্রাইভ করে সোনালী। বলে, এ সময় ড্রাইভারের উপস্থিতিটাই তার কাছে বিরক্তিকর। অনেকক্ষণ ধরে চোখের সামনে একটা বুড়ো শিখের ঘাড় পিঠ আর পাগড়ী দেখতে রাজী নয় সে।
পশ্চিমের ওই জানলাটা দিয়েই সোনালীর গতিবিধিটা দেখতে পাওয়া যায়। ওই দিকটাই বাড়ির গেট।
কে জানে কখন চলে গেছে সোনালী। হয়তো পশ্চিম আকাশটা লালচে হয়ে ওঠবার অনেক আগেই। কিন্তু একটাও চাকরবাকর কেন আসছে না এ ঘরে? * শশাঙ্কর কি একবার তেষ্টা পেতেও পারে না? চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হল শশাঙ্কর। যেমন করে সোনালী ডাকে অনন্তকে, বীরসিংকে, আছ কোথায় তোমরা? কাল হয়ে বসে আছ? সব কাজ বলে বলে তবে করাতে হবে, নিজেদের ডিউটি সম্বন্ধে জ্ঞান নেই?
না, শশাঙ্কর সে সাধ্য নেই।
চেঁচিয়ে কাউকে ডাকা শশাঙ্কর সাধ্যের বাইরে। নিজের গলার শব্দ নিজেই ভালো করে চেনে না শশাঙ্ক। তবু ওর ইচ্ছে হচ্ছিল এই মুহূর্তে কেউ এ ঘরে আসুক, অনন্ত কি বীরসিং, নিদেন পক্ষে ঠাকুর। জানলা দিয়ে রোদ আসা নিয়ে তাকেই বকে উঠবে শশাঙ্ক।