প্রভুর আদেশে টাকা দিয়ে রামদুলাল ব্যবসা আরম্ভ করেন। উত্তরকালে তিনি বিখ্যাত ধনবান হয়েছেন। দুঃস্থ নর-নারীকে তিনি অনেক সময় গোপনে টাকা পাঠাতেন, কে যে কোথায় থেকে টাকা পাঠিয়েছে, কিছুই তারা জানতে পারতো না। মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষে তিনি লক্ষ টাকা দান করেন। কলিকাতা হিন্দু কলেজ স্থাপনের জন্য তিনি ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
এইবার এক মুসলমান যুবকের মাহাত্ম বলবো–যা শুনলে আপনারা মনে করবেন এও কি সম্ভব!
বড় বাজারে এক তাঁতীর একখানা দোকান ছিল। একদিন দোকানে বেচাকেনা করবার সময় একটা জরুরি কাজে করিম বখ্শ বলে এক ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেলেন। করিম বখশ এক ঘন্টা দোকানে বসে থাকলো, কিন্তু তবুও দোকানদার ফিরে এলো না। এদিকে ক্রেতারা জিনিসপত্রের জন্যে তাগাদা করতে লাগলো, করিম বখশের জিনিসপত্রের দাম জানা ছিল, সে কয়েকখানা কাপড় বিক্রি করলো। দুঃখের বিষয় সারাদিন চলে গেল তবুও দোকানদার ফিরে এল না। করিম অগত্যা সেদিন আর বাড়ি যেতে পারলো না, দোকানদারের অপেক্ষায় সেখানেই রাত্রি যাপন করলো। পরের দিন যথাসময়ে দোকান খুলে করিম মালিকের অপেক্ষা করতে লাগলো–কিন্তু মালিকের আর সন্ধান নাই। করিম অগত্যা নিজেই বেচাকেনা করতে লাগলো। এইভাবে ২/৩ দিন, শেষে এক মাস কেটে গেল, তাঁতী ফিরল না। করিম দোকানের ভার ফেলে যাওয়া অধর্ম মনে করে বিশ্বস্ত ভূত্যের মতো কাজ চালাতে লাগলো। তাতী যাদের কাছে ঋণী ছিল, করিম তাদের সব টাকা পরিশোধ করলো। তাতীর হয়েই সে নতুন কাপড়ের চালান এনে দোকানের আয় ঠিক রাখলো। এক বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেল। করিমের আন্তরিক চেষ্টায় দোকানের ক্রমেই উন্নতি হচ্ছিলো, শেষে এক দোকানের পরিবর্তে তিনটি দোকান স্থাপিত হল। করিম সব দোকানই তাঁতীর নামে চালাতে লাগলো।
লোকে ভাবলো, করিম তাঁতীর দোকান কিনে নিয়েছে। করিমের সম্মান প্রতিপত্তি ইত্যবসরে খুব বেড়ে গেল, সে মস্ত সওদাগর হয়ে বিরাট কারবার চালাতে লাগলো।
প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। একদিন করিম দোকানের গদিতে বসে আছে, এমন সময় সে দেখলো, একটা বুড়ো লাঠি ভর করে তারই দোকানের সামনে করিম বলে একটা বালকের খোঁজ করছে। বুড়োর পরণে একখানা ময়লা কাপড়, রোগা চেহারা। শরীর একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে। তাকে ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছিল। করিম দৌড়ে এসে বুড়োকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বললো–আমি হচ্ছি সেই করিম, এই সাত বছর আমি আপনার দোকান পাহারা দিচ্ছি–দয়া করে এখন আপনি আপনার দোকানের ভার নিন, আমি বিদায় হই।
বৃদ্ধ করিমের মহৎ প্রাণের পরিচয় পেয়ে দুই চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন। বললেন–করিম, আমার আর কিছুর দরকার নাই, এসবই তোর! আমার এ সংসারে যারা আপন ছিল, সবাই ছেড়ে গেছে; এখন তুই আমার আপন। সেই সাত বছর আগের কথা, এখান হতে বেরিয়ে পথে সংবাদ পেলাম আমার পীর সাংঘাতিক পীড়া। কালবিলম্ব না করে আমাকে বাড়ি যেতে হয়েছিল। যেয়ে দেখলাম পত্নীর মৃত্যুর কয়েকদিন পরে ছেলে দুটি মারা গেল। তারপর নানা দুর্বিপাকে আমি পড়ি। কিছুতে বাড়ি ত্যাগ করতে পারলাম না। তারপর এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। এখন আমার কেউ নাই, আত্মীয় স্বজন, অর্থ, দেহের বল সব হারিয়ে এখন পথের ফকির হয়েছি। অতি দুঃখে অনেক আশা নিরাশায় মনে হল কলিকাতায় যেয়ে একবার করিমের সন্ধান করি, তাকে যদি পাই তার কাছ থেকে ২/১ টাকা ভিক্ষা নেবো। দোকান কি আর এত দিন আছে? করিম, আমি যে তোকে এমন রাজার হালে দেখবো, কখনও মনে করি নি। আর তুই যে কী, এমন করে। আমার কাছে পরিচয় দিলি, এ ভেবে আমার মনে যে আনন্দ হচ্ছে, তা আর কী বলবো। বল বাবা, তুই মানুষ না ফেরেস্তা!
করিম সবিস্ময়ে বললো–আপনি পিতার মতো আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। সে বিশ্বাসকে আমি রক্ষা করতে পেরেছি, এই আমার পক্ষে ঢের। এর বেশি আমি কিছু আশা করি নি।
তাঁতী করিমের হাত থেকে দোকানের ভার গ্রহণ করলেন না। জীবনে তার আর কোনো বন্ধন রইল না। একটা মাসিক বন্দোবস্ত করে তিনি অতঃপর তীর্থে চলে গেলেন।
মানুষের জীবন যে এত সুন্দর, এত পবিত্র হয়, তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। এই পাপময় মানব সমাজে মহৎপ্রাণ মানুষ আছে, মানুষ এদের নাম জানুক আর না জানুক, এরা যে জগৎকে ধন্য করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নাই।
জীবনের প্রকৃত আনন্দলাভ হয়–মহত্ত্বের ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়ে। যে জীবন পবিত্রতা, মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের আনন্দ হতে বঞ্চিত থেকে গেল, বৃথাই সে জীবন। এই উদার আকাশতলে এই আলোগন্ধভরা পৃথিবীর বুকে একবার পাপ, নীচতা ও অন্যায় হতে ফিরে দাঁড়াও–জীবনকে মহৎ ও গরীয়ান করে তোল।
শত্রুকে আঘাত দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু তার জন্য অশ্রুপাত করা বড় কঠিন। পরাজয়ের পর হিমু (হেমচন্দ্র বন্দি হয়ে আকবরের সম্মুখে নীত হলেন, তখন তরবারি হাতে করে অশ্রুপূর্ণ নয়নে বৈরামকে তিনি বললেন–ওস্তাদ সাহেব, এই দুর্বল রোগজীর্ণ বন্দিকে হত্যা না করে কী ক্ষমা করা যায় না?
আকবরের প্রাণের মহত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা বৈরামের ছিল না। তিনি দুর্বল শত্রুর মাথা নিজ হস্তে ছেদন করেছিলেন। বৈরামের শক্তি ও শৌর্য দেখে মানুষ যখন ভীত শঙ্কিত হয়ে উঠছিল।–সে আজ কত দিনের কথা, মানুষ সে গরিমার কথা ভুলে গিয়েছে কিন্তু মানুষ এখনও বালক আকবরের অশ্রু সম্ভ্রমের সঙ্গে মনে করে রেখেছে।