আমেরিকার কাছ দিয়ে সমুদ্রপথে একখানি যাত্রী জাহাজে এক ইংরেজ দম্পতি যাচ্ছিল। সঙ্গে তাদের কয়েকটি ছেলেমেয়ে। বড় মেয়েটির বয়স আঠার বৎসর হবে–তার নামটি আমার ঠিক মনে নাই। হঠাৎ জাহাজের কাপ্তানের কানে দূরের একখানি জাহাজের বিপদ সংকেতের ধ্বনি এসে লাগল। কাপ্তান দূরবীন দিয়ে দেখলেন, বহুদূরে একখানি জাহাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিকদের তিনি সেদিকে জাহাজ চালাতে হুকুম দিলেন। প্রায় অর্ধ ঘণ্টা পরে বিপন্ন জাহাজের নিকটবর্তী হয়ে দেখা গেল, জাহাজখানি জনমানবশূন্য। মাত্র ২-৩ জন লোক বিষণ্ণ মনে ডেকের একধারে মলিন মুখে বসে আছে। নূতন জাহাজখানি বিপন্ন জাহাজের পাশে লাগতেই তারা উঠে এল, সমস্ত যাত্রীরা তাদের কী বিপদ জানবার জন্যে সমুৎসুক হয়ে জাহাজের এক পাশে এসে দাঁড়ালেন।
কাপ্তানের প্রশ্নের উত্তরে তারা বললো ভীষণ কালাজ্বরে সবাই মারা গিয়েছে, যারা এখনও মরে নি তারাও মরার মতো হয়ে কেবিনের মাঝে পড়ে আছে। কেউ তাদের দেখবার নাই। আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী ভালো আছি। কালাজ্বরের কথা শুনে যাত্রীদের ভিতরে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল, কারণ এই জ্বর ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে–এ জ্বর হলে রোগী মরবেই!
কাপ্তান গভীরভাবে যাত্রীদিগকে লক্ষ্য করে বল্লেন–যাত্রীদের মাঝে এমন কেউ কি নাই, যিনি এই বিপন্ন লোকগুলিকে সাহায্য করবার জন্য যেতে পারেন! এ কথাও বলছি, যিনি এদের মাঝে যাবেন, তাঁর প্রাণের আশা খুব কম। মরবার পণ করেই এদের মাঝে যেতে হবে।
কেউ কথা বলছিল না। কাপ্তান আবার বললেন, এখানে যাত্রীর সংখ্যা অল্প, কিন্তু। তবুও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেবার মতো কি কেউ নাই?
একটি মেয়ে বললে–আমি এদের মাঝে যাব। সবার মুখ প্রশংসা ও শ্রদ্ধায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যে ইংরাজ দম্পতির কথা বলেছিলাম এই মেয়েটি তাদেরই!
মহৎ প্রাণ যুবতীটির মা কেঁদে বললেন, মা তুমি প্রাণ দেবার জন্য এদের মাঝে যাবে? তুমি মরো না, বেঁচে থাক।–আমার মরবার সময় হয়েছে, আমি এদের মাঝে যাবো।
মেয়ে বললে–না মা, সে কি হয়? দেখ, আমি এখন অবিবাহিতা, আমার জীবনের মূল্য নাই। আমার মৃত্যুতে জগতের বিশেষ কিছু আসবে যাবে না। তুমি মরে গেলে তোমার এ ছোট শিশুটির যত্ন করবে কে? মেয়েটির পিতা অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন–মা, আমি বুড়ো হয়েছি, আমার জীবনের মূল্য খুব কম। তোমরা বাড়ি যাও, আমিই বিপন্নদের সেবা করতে যাবো।
কন্যা বল্লো–বাবা, তুমি গেলে আমার ভাই-বোনগুলি আর কাকে অবলম্বন করে বাঁচবে? আর তুমি পুরুষ–তোমার কি সেবা-শুশ্রূষা করা সাজে? দয়া করে আমাকে অনুমতি দাও। সেবা দ্বারা জীবনকে ধন্য করবার সুযোগ আমাকে দাও। এর চেয়ে জীবনকে সুব্যবহার সব সময় ঘটে না।
সময় সংক্ষিপ্ত। অধিকক্ষণ অপেক্ষা করবার সময় ছিল না। পিতা স্নেহে কন্যার ললাট চুম্বন করলেন। মা, কন্যাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে সজল নয়নে বললেন–মা, ধন্য তোমার জীবন, তোমাকে পেটে ধরে আমিও আজ ধন্য হলাম।
জাহাজের যাত্রীরা সবাই এসে বালিকাটির সঙ্গে করমর্দন করলেন। ছোট ভাই বোনগুলিকে একবার কোলে করে এই মহাপ্রাণা বালিকা বিপন্ন যাত্রীদের জাহাজে নেমে গেলেন।
অনেক সময় দরিদ্রের মাঝে মহত্ত্বের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা যায়, শিক্ষিত ও বড়োলোকদের মাঝেও তা পাওয়া যায় না। দরিদ্র সাধারণ মানুষের মহত্ত্ব, সহৃদয়তা ও ছোট ছোট দানের নিকট জগৎ বহু পরিমাণ ঋণী। কয়েকটি হাসপাতাল বা অতিথিশালা মানুষের দুঃখের বহু পরিমাণ মীমাংসা করলেও পল্লীর সহৃদয় দীন-দুঃখী মানুষ নীরবে দুঃখ মোচন করে।
পরের অর্থ অপহরণ করে লোকে বড় মানুষ হয়েছে এরূপ দৃষ্টান্ত অনেক আছে। কিন্তু পরকে মানুষ কেমন করে একেবারে নির্লোভ হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে, তার গোটা দুই দৃষ্টান্ত আমি এখানে দেবো। এই সব মানুষ জড় দেহের ভোগ অপেক্ষা আত্মার সাত্ত্বিক তুপ্তির ভিখারি। মানব সংসারে এই ভাবের মানুষের আবির্ভাব বেঁচে থাকে। ভণ্ড নরপিশাচেরা এ জগতের কেবলই অকল্যাণ করে, আর মহাপ্রাণ জাতিরা জগতের কল্যাণ, সুখ ও আনন্দ বর্ধন করেন।
কলিকাতা মদন মোহন দত্তের বাড়ির ঝি-এর ছেলে রামদুলাল, দত্তের বাড়িতে সরকারের কাজ করতো। এই যুবক এক সময় প্রভুর টাকায় এক লক্ষ টাকা লাভ করে। রামদুলাল ইচ্ছে করলে এই টাকা নিজে নিতে পারত, তাতে তার বিশেষ অন্যায় হতো না। প্রভুর টাকা প্রভুকে ফিরিয়ে দিয়ে লাভের টাকা নিজে নিলে প্রভু কিছুই জানতে পারতেন না। রামদুলালের ভিতরে যে আশ্চর্য মহত্ত্বের গৌরব ঘুমিয়ে ছিল, তা তাকে বলেছিল, দুলাল, এই টাকা তুমি তোমার প্রভুকে দিয়ে দাও। জীবনের মহত্ত্বের কাছে এই লক্ষ টাকার মূল্য খুবই কম। দুলাল প্রভুর সামনে যখন লক্ষ টাকা রেখে দিয়ে বললে–মহাশয়,
আপনাকে না জানিয়ে আপনার টাকায় লাভ করেছি–এর উপর আমার কোনো অধিকার নাই, দয়া করে গ্রহণ করলে সুখী হবো। মদনমোহন বিস্মিত হয়ে বললেন–দুলাল, তোমার মধ্যে এত মহত্ত্ব এত মনুষ্যত্ব ছিল; তা তো কখনো বুঝি নি! মানুষ এক পয়সার জন্য কতখানি নীচতার পরিচয় দেয়, আর তুমি এক লক্ষ টাকা কী করে আমাকে দিচ্ছ? আমি তো এর কিছুই জানি নে। তুমি মানুষ না দেবতা!–এ টাকা আমাকে দিতে হবে না। এ টাকা তোমারই, এর উপরে আমার কোনো অধিকার নাই।