কিছু নাই, দেখ দেখি আমি কেমন করে নিজেকে জয় করতে পেরেছি, এতে তোমার আনন্দ হচ্ছে না? পরকে যদি অন্যায় করে ব্যথা দিতাম, তাতেই আমার দুঃখের কারণ হতো। যে আঘাত দিয়েছে, তারই লজ্জার কারণ বেশি।
মা অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন–বাপ তোর মধ্যে এত মহত্ত্ব, এত মনুষ্যত্ব জেগেছে? আমার বহু রাত্রির নয়ন-জলের প্রার্থনা তা হলে খোদা শুনেছেন। তোর বাপকে যেদিন রোমবাসীরা হত্যা করে, সেদিন তার কণ্ঠের খানিকটা লাল রক্ত আমি সংগ্রহ করেছিলাম, আমার বুকে যে মাদুলি দেখছিস এর মাঝে সেই রক্তটুকু একটু ছোট ন্যাকড়ায় ভরে রেখে দিয়েছি। আজ আঠার বছর শয়নে-স্বপনে এর রক্ত আমি টেনে বেড়াচ্ছি। তোর বাপের সেই ত্যাগ-মহিমার চিহ্ন আজ তোর গলে পরিয়ে দেবো।
এই কথা বলে প্যানক্রিয়াসের মা চোখের জলে কণ্ঠের মাদুলিটি ছেলের গলে পরিয়ে দিলেন।
এর কয়েকদিন পরে রোমবাসীরা যুবক প্যানক্রিয়াসকে ধরে নিয়ে চিতা বাঘ-দিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল। এ জগতে আগুন, আঁখিজল আর রক্তের ভিতর দিয়েই সত্য, কল্যাণ জয়যুক্ত হয়ে থাকে।
কত দুঃখের ভিতর দিয়ে হযরত মোহাম্মদ (সঃ), হযরত ঈছার (আঃ) ধর্মের সংস্কার সাধন করেন। মানব-সমাজের যখন অধঃপতন হয়, তখন শুধু ধর্মবিশ্বাস তাদেরকে বড় করে রাখতে পারে না। হযরত ঈছার (আঃ) মহাধর্ম যখন বিলুপ্ত হয়েছিল, তখনই আরব মরুভূমির মাঝে এক নতুন মহাপুরুষ মানুষের জন্য কল্যাণ-মন্ত্র নিয়ে দাঁড়ালেন।
যে কঠিন কথা বলতে পারে, সে নিজকে কত ছোট করে ফেলে। যে নীরবে অপমান। সহ্য করে শত্রুর মঙ্গল চায়–সে কত মহৎ! যিনি মহৎ। তিনি অপমানের বিরুদ্ধে সহজে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন না, তিনি অপেক্ষা করেন। আল্লাহর কাছে তিনি শত্রুর সুবুদ্ধির প্রার্থনা করেন। তিনি কাতরভাবে বললেন–হে খোদা, এরা কিছু বোঝে না, এদিগকে ক্ষমা কর।
জাতীয় অপমান সহ্য করা মহত্ত্বের লক্ষণ নয়, বরং তা কাপুরুষতা! প্রতিশোধ নেবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি প্রতিশোধ না নেই, সেখানেই চরিত্র মাহাত্ম্যের পরিচয় দেয়া হয়।
অপদার্থ ব্যক্তির অন্যায় ক্রোধের কথা শুনে চুপ করে থাকায় বিপুল মহত্ত্ব আছে। অন্যায় বা অপমানের কথা শুনে মনকে শান্ত করে রাখা সহজ কথা নয়। ক্রোধ যদি সংযত করতে পার, লোকে জানুক বা না জানুক, মহত্ত্বের পরিচয় নিয়ে যদি তুমি প্রাণে তৃপ্তি লাভ করতে পার তাহলে তোমার ভিতরে একটা দুর্জয় শক্তি জেগে উঠবে। ভিতরকার শক্তিই আমাদেরকে বড় করে তোলে–এ শক্তি লাভ হয় জ্ঞান চরিত্রবল আর পুণ্যকার্যে।
বড় মরণে যদি জীবনের বালাই হতে মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা কত সুখের হয়। এ জগতে কামনা-বাসনার কোনো তৃপ্তি নাই। অনন্ত ক্ষুধা মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। দুঃখ-পাপের কঠিন চাপে মানুষের হৃদপিণ্ড ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ জগতে কীসের সুখ? গত জীবনে যত সুখভোগ করেছি, তার একটুও তো মনে নাই–সে কেবল একটা বিরাট স্বপ্ন আর কিছু নয়।
যতকাল বেঁচে আছি ততকাল যেন কোনো অন্যায় না করি, জীবনে যে মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেবো সেই স্মৃতিটুকু মৃত্যুকালে আমার প্রাণে যথার্থ আনন্দ আনবে। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ পাপ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো, যথাসাধ্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট মোচন করতে চেষ্টা করবো। তারপর মৃত্যুর দ্বারা আমাদের মুক্তি হবে। এ জগতে অনন্ত কোটি মানুষ এসেছিল, কোথায় তারা? কত যুবক-যুবতী এ জগতে কত হাসি হেসেছে–কোথায় সে সব হাসি? কেন মিছে এই স্বপ্ন-ভস্মের জন্য এত মারামারি?
অভাব ও দারিদ্র মানুষের মনুষ্যত্বকে চূর্ণ করে দেয়, কী মহত্ত্বের পরিচয় সে দেবে? প্রাণ দিয়েই যে সব সময় মানুষের কল্যাণ করতে হবে, এমন কথা হতে পারে না। দুঃখী দরিদ্রকে অর্থ দিতে হবে, দরিদ্রের জন্য ভিখারি হতে হবে। কিন্তু যার কিছু নাই, সে তো পূর্বেই ভিখারি হয়ে আছে, সে আর কী দিয়ে ভিখারি হবে? অর্থ উপার্জন কর মানুষের জন্য, এরই নাম মহত্ত্ব! নয়নে অশ্রু, হৃদয়ে প্রেম, আর হাতে অর্থ মানুষকে মহৎ করে। জীবনে অর্থ সঞ্চয় করতে হবে–পরের জন্য। যে সঞ্চয় করে, পরের জন্য যিনি দরিদ্র জীবনযাপন করেন, মানব মঙ্গলে অর্থ ব্যয় করেন, তিনি নিশ্চয়ই মহৎ।
ব্রহ্মদেশে একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, এক ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকার চাল দুঃস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছিলেন। দরিদ্রের পক্ষে মানুষের এত কল্যাণ করা কি সম্ভব?
মহৎ যিনি, তিনি বড়। ক্ষমতা আছে, কিন্তু যে ক্ষমতার নিত্যই অপব্যবহার হয়, অর্থ আছে–কিন্তু যে অর্থ কেবল জমিদারি ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যায়, এরূপ ক্ষমতা ও অর্থের মালিককে বড় বলা যায় না। যারা তার কাছে লাভের আশা করে, যারা তার আত্মীয় তারাই। তার তোষামোদ ও প্রশংসা করে। জ্ঞানী ও সত্যের সেবক যারা তারা এদেরকে সম্মান করেন না।
ইচ্ছা করলে ধনীরা জীবনে কত মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারেন? মানুষের লক্ষ মণ অর্থ থাকলেও যদি সে জ্ঞান–দরিদ্র হয়, সে বোঝে না প্রকৃত ধর্মপালন কীসে হয়। প্রেমহীন মায়াহীন নিষ্ঠুর প্রাণের উপাসনার যে কোনো মূল্য নাই–এ কথাও সে জানে না। সে পীড়িত নর-নারীর বুকের উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি ওজু করে মিলাদ ও ধর্মসভায় যোগ দেয়।