ছেলে–মা কীসের ভয়? বিশ্বাসের জন্যে বাপ মৃত্যুবরণ করেছিলেন, এর চেয়ে মহনীয় মৃত্যু কি আর আছে? আমার যদি অমনি করে মরণ হয়, তাতে আমার জীবন ধন্য হবে!
মা–বাপ, তুই অমন কথা কী করে বললি? তুই যে এখনো আমার দুধের ছেলে। আজ আমার জীবন সার্থক হল। কে তোকে এমন মধুর কথা শিখিয়েছে?
ছেলে–মা, তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছো, সত্য ও ন্যায়ের জন্য আমাদিগকে যে কোনো ক্ষতি স্বীকার করতে হবে! গৌরবময় মরণের মধ্যে দিয়ে যে মুক্তি আমরা পাই, তা কত সুন্দর। মহান মৃত্যু দিয়ে দুঃখময় পঙ্কিল জগতের মাঝ থেকে যদি জীবনের অভিশাপকে সরিয়ে নেওয়া যায়, তবে তা মানুষের পক্ষে কত বড় লাভ!
মা–বাপ, তুই আর ছোট ন’স, এই এখন মানুষের মতোই কথা বলতে শিখেছিস। আজ আমার নারী জীবন সার্থক হয়েছে কিন্তু তোর বাড়ি ফিরতে এত দেরি হল কেন, সে কথা তো এখনও বললি না?
প্যানক্রিয়াসের মুখ হঠাৎ কালো হয়ে গেল। অশ্রুভারে চোখ দুটি ছলছল করতে লাগলো। বললে–তুমি আর তা শুনো না মা।
মার চোখেও পানি এলো–সন্তানের এতটুকু ব্যথাও যে তিনি সইতে পারেন না। তিনি জিদ করে বললেন–না বাপ, আমার কাছে কোনো কথা গোপন করিস না। কী হয়েছিল বল।
প্যানক্রিয়াস–আজ স্কুলে একটা সভা ছিল–সভার আলোচ্য বিষয় ছিল–পণ্ডিত যিনি, সত্যের জন্য সব সময় মরতে প্রস্তুত থাকবেন। আমি এ সম্বন্ধে সভায় যখন প্রবন্ধ পড়ছিলাম, তখন সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়েছিল। প্রবন্ধ শুনতে শুনতে কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছিল। আমাদের শিক্ষক মহাশয়ও কেঁদেছিলেন। প্রবন্ধ পড়বার কালে মনের আবেগে হযরত ঈছার (আঃ) নাম করে ফেলেছিলাম। তাই সভা যখন শেষ হয়ে গেল, শিক্ষক মহাশয় গোপনে ডেকে বললেন–বাবা, দেশের অবস্থা খারাপ, চারদিকে শত্রুর কান খাড়া হয়ে আছে। এই কথা বলে তিনি চোখ মুছে আমার কাছ থেকে চলে গেলেন।
মা–শিক্ষক মহাশয় কি তা হলে হযরত ঈছাকে (আঃ) মানেন? তার চরিত্রবল, তার পবিত্র জীবনের প্রশংসাই এতকাল শুনেছি, তিনি যে এমন করে আত্মগোপন করে আছেন, তা তো বুঝি নি। খোদাকে ধন্যবাদ, তোমাকে উপযুক্ত শিক্ষকের হাতেই দিতে পেরেছি। তারপর?
প্যানক্রিয়াস–তারপর আমি আর ছেলেদের সঙ্গে স্কুলের মাঠে এসে দাঁড়ালাম। নগরের হাকিমের ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ে। সেই ছেলেটি ভারি বদমাইস। কী কারণে জানি না, ও আমাকে বিষ চোখে দেখে। আমি ক্লাশের মাঝে সবার চোখে ভালো ছেলে, আর সে ক্লাশের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছেলে। আমার প্রশংসা শুনলে তার যেন মরণযন্ত্রণা উপস্থিত হয়। আমাকে মোটেই দেখতে পারে না। আমি যে তার কাছে কী অপরাধ করেছি। জানি নে, ভারি হিংসুক আর বদ ছেলে সে। আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে,–কিহে প্যানক্রিয়াস, তুমি আমাকে ভয় কর না? এই কথা বলে সে বিনা কারণে আমায় ধাক্কা দিলে।
আমি বললাম–এরূপ অসভ্যতার পরিচয় দিচ্ছ কেন? সে বললে–দ্যাখ প্যানক্রিয়াস, তুই নানা রকমে আমার সঙ্গে শত্রুতাচরণ করেছিস, আমার পায়ে ধরে যদি ক্ষমা চাস তা হলে তোকে ক্ষমা করবো, নইলে নয়। রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল, কিছু না বলে আমি চুপ করে রইলাম–তুমি না আমায় বলেছ, যে রাগকে জয় করতে পারে, সে-ই মানুষ,–সেই কথা আমি তখন মনে করছিলাম।
মা–তাই ঠিক বাপ।
প্যানক্রিয়াস–মা, এরপর যা ঘটেছে তা আর বলতে পাচ্ছি নে–এই কথা বলে প্যানক্রিয়াস কাঁদতে লাগল।
মা ছেলের মাথা বুকের কাছে টেনে বললেন, “বাপ, তুই আমার কাছে সব কথা বল।”
প্যানক্রিয়াস আবার বলতে শুরু করলে, আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। সেই ছেলেটির নাম কারভিন।
কারভিন আবার বললে–প্যানক্রিয়াস, আমি কার ছেলে তা তুই জানিস? ক্লাশে লেখাপড়ায় তুই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তোর অহংকার ভরা চাউনিগুলি আমার অন্তর বিদ্ধ। করে। আচ্ছা এইবার আয়, কার গায়ে কত জোর পরীক্ষা হোক। আমাকে ভয় করতে হবে কিনা এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি।
আমি বললাম তোমার গায়ে আমার চেয়ে বেশি শক্তি আছে। আমি মারামারি করতে পারব না।
মা–এরপর কী হল?
ছেলে–আমি তাকে খুব পিটিয়ে দিতে পারতাম। কী কষ্টে যে আমি আমার রাগ দমন করতে পেরেছি, তা আর কী বলব মা। ‘কাপুরুষ’ গালটা আমার বড় লাগে। যার বাকা হৃৎপিণ্ডের রক্ত দিয়ে নিজের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছেন–সে কাপুরুষ! প্রাণে কী জ্বালা উপস্থিত হল, তা খোদাই জানেন। ভিতরকার ক্রোধ শয়তানকে শেষকালে জয় করতে পেরেছিলাম। হেসে বললাম–ভাই কারভিন, তুমি আমাকে অন্যায় করে আঘাত করলে। তবে আমার বিশেষ লাগে নি, একটু রক্ত পড়েছে মাত্র, শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। প্রার্থনা করি তোমার স্বভাবের এই প্রচণ্ড উগ্রতার শীঘ্রই পরিবর্তন হোক। আমাদের শত্রুতার এইখানে অবসান হোক–এরপরে যেন তোমার বন্ধু হতে পারি।
গোলমাল শুনে শিক্ষক মহাশয় সেখানে এলেন। আমি তাকে হাতে ধরে অনুনয় করে বললাম-শিক্ষক মহাশয়, কারভিনকে দয়া করে কিছু বলবেন না। ছেলেমানুষী করে এই কাজ করে ফেলেছে, ওকে ক্ষমা করুন। এজন্য আমি ওর উপর একটুও ক্রুদ্ধ হইনি।
শিক্ষক মহাশয় ভয়ানক চটে ছিলেন। আমার কথায় অগত্যা শান্ত হয়ে গেলেন। এসব কারণে বাড়ি আসতে বিলম্ব হয়েছে। মা, তোমার মনে কি ব্যথা লাগছে? মা, ব্যথার তো