রামতনু লাহিড়ী মহাশয় একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি খুব ব্যস্ততার সঙ্গে পথ অতিক্রম করতে লাগলেন, যেন কে তাকে মারতে তাড়া করছে। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আবার স্থির হলেন। সঙ্গের বন্ধুটি ব্যস্ততার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন–ভাই, এক ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। আমি জানি তার অবস্থা বড় শোচনীয়, টাকা দেবার কোনো সঙ্গতি নাই। আমার দিকে তিনি আসছিলেন। আমি দ্রুত গতিতে পাশ কাটিয়ে সরে এসেছি। আমাকে দেখলে তার ভারি লজ্জা হত! ভদ্রলোককে কী করে লজ্জা দেব, এই ভেবেই আমি পালিয়ে এলাম। এমন করে পরের লজ্জায় ব্যথাকে অনুভব করবার ক্ষমতা কয়জনের থাকে। সাধারণত সব সময়ই মানুষ লজ্জা, ব্যথা দিতে আনন্দ বোধ করে।
জাতি বল, বংশ-মর্যাদা বল, মহত্ত্বের তুলনায় কিছুই কিছু নয়। মানুষ যেখানেই চরিত্র মাহাত্ম্য দেখে সেখানেই ভক্তিতে তার মাথা নত হয়। বড়লোক বলেই কি মানুষ বেশি শ্রদ্ধা পাবার উপযোগী? বড়লোককে মানুষ লাভের আশায় শ্রদ্ধা দেখতে পারে, কিন্তু কুস্বভাব লোক কখনও মানুষের অন্তরের রাজা হতে পারে না। মানুষ ছোট হোক, বড় হোক, দরিদ্র হোক, যখনই তার মধ্যে মহত্ত্ব দেখবো, তখনই তাকে আমরা শ্রদ্ধা করবো। ছোটলোক বলে সমাজে যে সর্বনিম্ন স্তরে পড়ে আছে সে কি মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারে না?
আমি দেখেছি ব্যথিত মানুষের গৌরবদীপ্ত মুখ, সে মুখ কত সুন্দর! কত পবিত্র? রূপ যদি মানুষের থাকে, তবে তা মহত্ত্বের আলোকভরা মুখেই আছে। রূপবান রূপময়ী নর নারীর নীচাশয়তা তাদের রূপকে কতখানি কুৎসিত করে, তাও আমি দেখেছি।
যা বিশ্বাস করি, মানুষের ভয় অথবা লাভের আশায় তা বলতে ভয় করা কত বড় দুঃখের বিষয়! এই অবিচারটুকু জয় করবার জন্যেই মানুষ স্বাধীনতা চায়। বিশ্বাসকে যে যতখানি চেপে রাখে সে ততখানি দরিদ্র। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, তিনি কিছুতেই জীবনের সত্যকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দিতে চান না। এতে তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হয়।
অনেক টাকা মাইনে পাই, সেই লোভে কী করে আমি আমার কোটি টাকার আত্মাটিকে বিক্রয় করতে পারি? আমার দুর্জয় মনুষ্যত্ব আমার জীবনের উচ্চ সার্থকতা আমি কোনো জিনিসের বিনিময়েই নিরর্থক করে দিতে পারি না। অর্থ অর্জন করে শরীরকে বাঁচান হবে, অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকদের কাছে খুব প্রশংসা লাভ করা যাবে, বন্ধু-বান্ধবেরা আমার সুনাম জ্ঞান করবে; কিন্তু তাতে যদি আমার আত্মার ভাষা নীরব হয়ে যায়, আমার মনুষ্যত্ব নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে, তা হলে আমি আমার শরীরকে বাঁচাতে চাই না, আমি কারো প্রশংসা, কারো সুনাম পাবার লোভ করি না।
তখনও হযরত মোহাম্মদ (দঃ) তার সংস্কারের বাণী নিয়ে জগতে আসেন নি। রোম নগরে এক বাড়িতে বসে একদিন এক মহিলা সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। বাড়িতে তিনি একাকিনী ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি দরজার দিকে চাচ্ছিলেন কেউ দরজা ঠেলে ভিতরে আসে কি না।
তখন ছিল হযরত ঈছার (আঃ) যুগ। রোমের যারা মূর্তি পূজা ছেড়ে হযরত ঈছার (আঃ) সত্য ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের উপর ভারি অত্যাচার হতো। কোনো রকমে যদি শাসক সম্প্রদায়ের কেউ জানতে পারত কোনো ব্যক্তি ঈছার (আঃ) ধর্ম গ্রহণ করেছে, তখন তখনই তাকে বাঘের মুখে ফেলে দেয়া হতো। নানান নির্যাতনে তাকে মেরে ফেলা হতো। ফলে নব ধর্মাবলম্বীদিগকে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস গোপন করে রাখতে হতো। যারা তা পারত না, তাদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল, এইভাবে বহু ধর্মপ্রাণ রোমবাসীকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। যে নারীর কথা বলছিলাম,–এর স্বামী কিছুদিন আগে ধর্মবিশ্বাসের জন্যে শহীদ হয়েছিলেন।
প্রাণভয়ে মানুষ নিজের বিশ্বাস ও সত্যকে অনেক সময় গোপন করে চলে, কিন্তু সামান্য লাভে বা কল্পিত সুখের জীবনের জন্যে যে নিজেকে অবনমিত করে, নিজের মনুষ্যত্ব ও বিবেক-বুদ্ধিকে বিসর্জন দেয় সে কীরূপ মানুষ!
মহিলাটির একটি ছেলে ছিল তাকে রেখে তাঁর পিতা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ছেলেটি বাড়িতে মাকে একাকিনী রেখে প্রত্যহ স্কুলে যেতো। স্বামীর একমাত্র ছেলে প্রৌঢ়ার নিঃসহায় নারী জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা। আজ বিদ্যালয় হতে ফিরে আসতে বিলম্ব করছে তাই আকুল ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নারী জাতির সন্তানের প্রতি কত মায়া তা আমরা ধারণা করতে পারি না। মায়ের মূর্তিতে নারী কত বড়! নারী দরিদ্র হোক, পতিতা হোক, সন্তানকে বুকে করে সে রানীর আসন অধিকার করে। নারী যখন শিশুর মুখে সুধা ধারা ঢালে, তখন তাকে মা বলে সালাম করলে দোষের হয় না। নারীকে যেখানে আঁখিজল ফেলতে হয়, সেখানে খোদার অভিশাপের আগুন জ্বলে।
প্রৌঢ়ার হাতের কাজ ভুল হয়ে যাচ্ছিল। ছেলে বাড়ি আসতে দেরি করছে। বাতাস দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেল, প্রৌঢ়া চমকিত হয়ে চেয়ে দেখলেন, কেউ না।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময় বালক প্যানক্রিয়াস বাহির হতে ‘মা’ বলে ডাকল। হাতের কাজ ছুঁড়ে ফেলে প্রৌঢ়া দরজা খুলে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন-বাপ, আজ যে তোর এত দেরি হল? বালক বললো—”কেন ‘মা’ এত ব্যস্ত হয়েছ? আমার বয়স তো আঠার।” মা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে একখানা চেয়ারের উপর বসলেন। ছেলে মাটিতে মায়ের পায়ের কাছে বসে কোলে বাহু রেখে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মা ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন–”আজ কেন এত দেরি হল? তুই তো রোজ বেলা থাকতে আসিস। জানিস তো নিজের দেশে আমরা কতটা প্রবাসী হয়ে বাস করছি। তোর বাপকে রোমবাসীরা হত্যা করেছে–আমার সব সময় মনে ভয় হয়।”