সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। শীত আর শারীরিক কষ্টে বালকটি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হল–মায়ের মুখোনি মনে করে তার চোখ দুটি পানিতে ভরে উঠেছিল। কাছে কিনারে লোকজনের বিশেষ বসতি ছিল না। খোদা সব জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন এ তোমরা বিশ্বাস। কর। মানুষের জীবনের দুঃখ দেখলে তিনিও দুঃখ বোধ করেন, তখন তিনি ব্যথা পেয়েও কিছু করেন না। মানুষ ইচ্ছা করে পাপ বরণ করে নেয়, খোদা তার গতিকে রোধ করেন না। এরূপ করলে তার সৃষ্টির আইন-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। খোদা কতবার আঁখিজলে মানুষকে ‘আয়’ ‘আয়’ করে ডাকছেন, অবোধ মানুষ তা দেখে না। খোদা জলে, স্থলে, সারা পৃথিবীর পথে পথে মানুষের জন্যে কেঁদে বেড়াচ্ছেন। মানুষ তা জানে না।
একটা রমণী কী একটা কাজে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বালকের রোদন শুনতে পেলেন। নারীর প্রাণ-স্নেহ মমতায় ভরা। রমণী বালকের নিকটে এসে স্নেহের স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা তোমার কী হয়েছে? বালক মায়ের মতোই এক নারীমূর্তিকে দেখে কথা বলতে সাহস পেলো। সে বললো—মা, তোমার মতনই বাড়িতে আমার এক মা আছেন। তাঁর কথার অবাধ্য হয়ে আমি পালিয়ে এসেছিলাম, এখন বিপদের একশেষ। হয়েছে। শীতের দিনে গায়ে কাপড়-চোপড় নাই, গায়ে জ্বর এসেছে, অজানা-অচেনা দেশ, কোথায় যাই। মায়ের অবাধ্য হয়ে এখন আমাকে পথে পড়ে মরতে হল।
নারী বললেন, তোমার কেউ না থাকুক, আমি আছি। আমি তোমার মা। চল আমার সঙ্গে, বেশি দূর নয়। কাছেই আমার বাড়ি।
বালক–মা, আমার তো উঠবার সাধ্য নাই, হাত-পাগুলি হিম হয়ে ভেঙ্গে আসছে।
আচ্ছা, তা হলে আমার কোলে এসো, এই বলে রমণী বালককে কোলে তুলে নিলেন। বালককে বুকে নিয়ে নানা সান্ত্বনার কথা বলতে বলতে রমণী বাড়িতে এলেন। ঘরের মেঝেয় বিছানা পেতে সেখানে বালককে শোয়ালেন। সে রাত্রিতে আর তার খাওয়া হলো না–সারা রাত্রি বালকের বিছানার পাশে বসে রইলেন। তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছিল। আহা! কার এ ব্যথার ধন। এই অজানা দেশে পথে পড়ে মরছিলো। ভাগ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এর কী অবস্থা হতো?
পরদিন রমণী নিজের খরচে ডাক্তার ডাকলেন। অনেক সেবা-শুশ্রূষায় অবশেষে। বালক বেঁচে উঠলো। রমণীটিও আনন্দে ভাবলেন আমার কষ্ট স্বীকার সার্থক হল। এখন মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যাক।
আরও কয়েকদিন পরে রমণীটি বালককে কিছু রাস্তা খরচ আর একখানা নূতন কাপড় দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে প্রস্তুত হলেন। প্রাণের কৃতজ্ঞতায় চোখের পানিতে রমণীর আঁচল ভিজিয়ে বালক বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
ব্যথিত বিপন্ন মানুষকে যে একটা স্নেহের কথা বলেছে, সেই মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছে। মানুষ যখন বিপন্ন হয়ে পড়ে, যখন রোগযন্ত্রণায় তার শরীর ভেঙ্গে আসে, যখন সে মরণ পথের যাত্রী, তখন তার সেবাশুশ্রূষা করাতে যথার্থ মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া হয়। বিপন্ন। ব্যক্তি পরিচিতই হউক আর অপরিচিতই হউক, তাকে আপন বলে বুকে টেনে নিতে হবে। মানুষ মাত্রই মানুষের আত্মীয়–এ যে মনে করতে পারে তার ধর্ম বিশ্বাসের মূল্য খুব বেশি। সারা পৃথিবীর বিপন্ন মানুষকে তুমি কাছে টেনে আন, এত বড় দাবির কথা বলবার সাহস আমার নাই, কিন্তু তোমার চোখের সামনে যে মরে যাচ্ছে তার দিকে তুমি ফিরে তাকাবে।? তোমার কানের কাছে যে আর্তনাদ করছে তার পানে কি তুমি একটুও অগ্রসর হবে না?
সিরাজগঞ্জে এক কাঠওয়ালার কলেরা হয়। বাজারের এক পতিতা নারীকে তার সেবা করতে দেখেছিলাম। সেই পতিতার মধ্যে দেখেছিলাম আমি–নারীর মাতৃমূর্তি, সে কী পবিত্র দৃশ্য! শ্রদ্ধাভক্তিতে আমার মাথা নত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুখ খুলে কিছুই প্রকাশ করতে পারি নি। নারী মাতৃমূর্তি কত সুন্দর! কত পবিত্র! মাতৃরূপিনী নারী জাতির যখনই আমরা অপমান দেখি, তখন মন দুঃখিত হয়ে উঠে। সে হিন্দু কি মুসলমান, সে কথা ভাববার অবসর থাকে না।
এক ব্যক্তির কথা জানি, তিনি এক সময়ে একজনের কাছ থেকে এক আনা পয়সা ধার নিয়ে কী একটা জিনিস কিনেছিলেন, কাছে তখন পয়সা ছিল না। বাড়ি এসে টাকা ভাঙ্গিয়ে সেই লোকটিকে পনেরো আনা দিয়ে নিজে মাত্র এক আনা রাখলেন; লোকটি বিস্মিত হয়ে বললেন–আপনি আমার কাছ থেকে মাত্র এক আনা নিয়েছেন, এখন পনেরো আনা দিচ্ছেন কেন? আপনার ভুল হয়েছে। ভদ্রলোক বললেন, বাকি পনেরো আনা তোমাকে দিলাম ওটা তোমার নিতেই হবে। লোকটি অগত্যা সে পয়সা নিতে বাধ্য হল।
এখানে এই ভদ্রলোকের চরিত্র-মাহাত্ম সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক। জ্ঞান ব্যতীত মানুষের কোনো জায়গাতেই কল্যাণ নাই, কেমন করে যে উদারতা ও মহত্ত্বের পরিচয় দিতে হয় তা সে বুঝতে পারে না। এজন্যে জ্ঞানের আসন সর্বোপরি। ভদ্রলোকের প্রাণের প্রশংসা না করে পারি না। তার নির্মল সুন্দর আত্মাটি ভক্তি পাবার যোগ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা প্রশ্নের উদয় হয়। তার এই দান সত্যই কি মানবজাতির অনুকরণের জিনিস? আমার মন ভয়ে সঙ্কোচে উত্তর দেয়-না।
মানুষকে দান কর, কিন্তু দান করবার জন্যই কি দান করতে হবে? দেখতে হবে প্রদত্ত পয়সায় দানপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রকৃত উপকার হবে কিনা। যার আছে, তাকে আরও দিলে পয়সার অপব্যবহার করা হয় না কি? সে সেই পয়সা পেয়ে আনন্দ লাভ করতে পারে, কিন্তু সে আনন্দটুকু তার না হলেও বিশেষ ক্ষতি আছে বলে মনে হয় না। এইসব টাকা দিলে জাতির কত কল্যাণ হয়, অজ্ঞান মূর্খ লোকেরা তা বোঝে না! অগণিত টাকা ব্যয় করে তার মহত্ত্বের পরিচয় দেয়। মানুষকে সবার আগে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, জ্ঞানের দ্বারা মানুষ তার জীবনের সকল কর্ম ঠিক করে নিতে পারে তাকে বলে দিতে হয় না, এই পথে তুমি চল। জ্ঞান যার নাই, সে কিছুই বোঝে না, মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।