আহম্মদ শাহ অবিলম্বে জামাতার পুনর্বিচার করে তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন।
মহৎ ব্যক্তির কাছে সকলেই সমান, আপন-পর নাই। অন্যায় যে করেছে, সে আপন রক্তের কেউ হলেও তিনি তাকে শাস্তির হাত হতে রক্ষা করতে পারেন না।
তুমি অত্যাচারী বড় মানুষ আছ, তুমি গোপনে কোনো দরিদ্রের সর্বনাশ করেছ, তুমি আমার মিত্র, তোমার পত্নীর সঙ্গে আমার পত্নীর আলাপ আছে, তাই বলে কি তোমার সপক্ষে আমি কোনো কথা বলতে পারি? আমি আঁখিজলে তোমার ধ্বংসের ব্যবস্থা করবো। তুমি মিত্র বলে আমার বেশি আত্মীয় নও, মানব মাত্রেই আমার আত্মীয়। যে অত্যাচারী, যে মিথ্যার উপাসক, যে হীন দুবৃত্ত, সে আমার আত্মীয় হলেও কেউ নয়।
যে মহৎ, যে বড়, তাকে প্রশংসার লোভ না করেই বড় ও মহৎ হতে হবে। জাতির মধ্যে যখন বড় চরিত্র ও উন্নত জীবনের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তখন জাতির দুরবস্থার কথা ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতে হয়। কতকগুলি কাপুরুষ, মূর্খ ও হীন মানুষের জীবন জাতির দেহে শক্তি সঞ্চার করতে সক্ষম নয়। জাতির শক্তির পরিচয় পাওয়া যাবে তখন, যখন তার সন্তানগুলি মহত্ত্বকে সম্মান করতে শিখবে–যখন তারা ন্যায় ও সত্যকে সমাদর করতে জানবে।
জীবনের সব সময় ছোট বড় সকল কাজে মহত্ত্ব ও সুন্দর চরিত্রের পরিচয় দিতে হবে।
শত্রু রোমের দুয়ারে হামলা করেছে। তখনই তারা পঙ্গপালের মতো এসে রোম নগর ধ্বংস করে। আর তো সময় নাই। নদীর ব্রীজ ভেঙ্গে দিতে পারলে রক্ষা পাওয়া গেল নইলে আর কোনো উপায় নাই। যুবক হোরেশিও বল্লেন, দেশের সম্মান রক্ষা করবার জন্য কে কে প্রাণ দিবার জন্যে আমার সঙ্গে যাবে–মৃত্যু অবধারিত; কারণ পেছন থেকে ব্রীজ ভেঙ্গে দিলে আমরা আর কিছুতেই ফিরতে পারবো না। মরতে আমাদিগকে হবেই। দুজন। বীর যুবক হোরেশিওর সঙ্গে গেল ব্রীজ ভাঙ্গার জন্য আরও মানুষ তাদের সঙ্গে গেল। পেছনের লোকদিগকে হোরেশিও চিৎকার করে বললেন, আমরা সম্মুখে দাঁড়িয়ে শত্রুদের গতিরোধ করছি, তোমরা পিছন থেকে ব্রীজ ভেঙ্গে দাও। শত শত লোক মুহুর্মুহু ব্রীজের উপর আঘাত করতে লাগলো। সম্মুখের অগণিত সৈন্যের সামনে তিন বীর যুবক কুড়ুল তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। শত্রুর বজ্র-ভীষণ আক্রমণের অপেক্ষা করতে লাগলেন। পেছনের লোকগুলি প্রাণপণ শক্তিতে ব্রীজকে ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো।
শত্রুদল ব্রীজের সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়ে দেখলো, ব্রীজ ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা হচ্ছে–রোম নগরে প্রবেশ করবার এই একমাত্র পথ। ব্রীজ ভেঙ্গে গেলে তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাবে। কোনো রকমে নগরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। সেনা নায়ক হুকুম দিলেন–আর বিলম্ব নয়। হোরেশিও আর তার দুই সহযোগীর কুঠারকে ভয় করো না। ব্রীজ ভেঙ্গে গেলে আমাদের অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না।
হোরেশিওর দুঃসাহস দেখে মুহূর্তের জন্য শত্রুরা একটু হেসে নিলে, এতবড় সৈন্যবাহিনীর সামনে মাত্র তিনটি বীর। কী উন্মত্ততা!
শত্রুরা হোরেশিওকে শত শত অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করলো। দুই হাত দিয়ে দীর্ঘ কুড়ুলের বাঁট ধরে হোরেশিও শক্ৰদলকে আঘাত করতে লাগলেন। সে কী ভীষণ দৃশ্য! কী অমানুষিক শক্তি-পরীক্ষা! সিংহের সামনে মেষপালের যেমন অবস্থা হয়, বিক্রম-উন্নত বীরবর হোরেশিওর সামনেও শত্রুদের তেমনি অবস্থা হতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ লড়তে পারলেই কাজ হাসিল হয়; আর পনেরো মিনিটেই ধ্বংসকার্য শেষ হবে। হোরোশিও প্রাণপণ শক্তিতে লড়তে লাগলেন, যায় প্রাণ যাবে, দেশের লক্ষ নর-নারীর স্বাধীনতা সম্মান তার হাতে। এত বড় মহত্ত্বের পরিচয় দিবার সুযোগ আর আসবে না।
পার্শ্বেই দুই ব্যক্তি অবসন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর পাঁচ মিনিট হলেই কাজ হাসিল হয়।
এইবার ব্রীজ বজ্রের শব্দে নদীর মধ্যে ভেঙ্গে পড়লো। হোরেশিও কুড়ুল দূরে নিক্ষেপ করে খরস্রোতা স্রোতোস্বিনীর মাঝে ঝাঁপ দিলেন। দশকে রক্ষা করা হয়েছে, এইবার মরণেও আনন্দ।
তীরে দাঁড়িয়ে অসংখ্য নরনারী আনন্দ-চিৎকার গগন কাঁপিয়ে তুলছিল। রোমবাসীরা তীর হতে নৌকা নিয়ে অগ্রসর হল। শত্রুরা অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখতে লাগলো।
মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া মানুষের পক্ষে যদি অসম্ভবও হয়, তবু সে নীচতার পরিচয় কেন নেয়? জীবনকে পাপ ও অন্যায়ে কলঙ্কিত কেন করে? দিনে-দুপুরে মানুষের মাথায় বাড়ি দেওয়া, পত্নীর উপর অত্যাচার করা, ব্যভিচার-স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া, পত্নীর দাবিকে অগ্রাহ্য করে চরিত্রহীন হওয়া–এইগুলিকেই শুধু পাপের পূর্ণ চিত্র বলা যায় না। মানুষের শত রকমে পতন হয়, শত রকমে সে তার মানুষ্যত্বের অপমান করে। নিজেকে অপমান করবার মতো লজ্জা মানব-জীবনে আর কি আছে? আত্মসর্বস্ব হয়ে জীবন কাটানো, জ্ঞানাবদ্ধ মানুষের দুঃখ পাপকে সহ্য কর, নিজের ও জাতির মূর্খতায় কিছুমাত্র কষ্ট বোধ না করা–নিকৃষ্ট মানুষের স্বভাব।
এক সময়ে এক বালক কোনো শহরের পথে বসে কাঁদছিল। সে বাড়ি হতে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে এসেছিল, হাতে তার একটা পয়সাও ছিল না–তখন শীতকাল, শীতের কাপড়ও সঙ্গে ছিল না। এর উপর বালকের গায়ে জ্বর এসেছিল, সে সেই অপরিচিত দেশে কাকেও চিনতো না, কারো কাছ থেকে কেমন করে সাহায্য চাইতে হয় তাও সে। জানত না। পথিকেরা কয়েকবার তার কাঁদবার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল–কিন্তু বালক উত্তরে কিছুই বলতে পারে নি।