খলিফা আলী (রাঃ) যখন মুসলমান সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হলেন, তখন সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি জনমণ্ডলীকে বল্লেন–আমার চেয়েও যদি কোনো শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্ধান আপনারা পান, তবে তাকেই সিংহাসনে বরণ করে নিন। আপনাদের আদেশ আজ আমি গ্রহণ করলাম, কিন্তু যখনই উপযুক্ত ব্যক্তি সন্ধান পাবেন, তখন যেন আমাকে বাদ দেওয়া হয়। হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন একজন যথার্থ ভদ্রলোক। তাঁর মধ্যে যে মহত্ত্ব, মনুষ্যত্বের গরিমা ছিল, তার তুলনা কোথায়?
ভদ্রলোক সব সময়েই ভদ্র। তিনি মানুষকে শ্রদ্ধা করতে ভালবাসেন। তিনি শ্রদ্ধা করে, মানুষকে–মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের পথে আকর্ষণ করেন। তাঁর মুখের স্থির গাম্ভীর্য তার দৃষ্টি, তাঁর কথার আশ্চর্য ভঙ্গি মানুষকে আশ্চর্য রকমে উন্নত করে তোলে, তিনি উগ্র কঠিন হয়ে কারো কাজের সমালোচনা করে না, তার স্পর্শ, তার সঙ্গ আত্মার উপর মহত্ত্বের আলোক ছড়াতে থাকে। তার হাসিটুকু মানুষের মনে স্বর্গের কিরণ এনে দেয়। তিনি কাপুরুষ নন, অথচ তার তেজ কখনও উগ্রভীষণ হয়ে দেখা দেয় না। তিনি বিপদে ধৈর্য ধারণ করেন, ঝঞ্ঝার মাঝে তিনি আশা, আনন্দ ও শক্তির অমৃত বর্ষণ করেন।
ভদ্রলোক কখনও নীচ নন। মনের স্বাধীনতা রক্ষা করতে তিনি সদাই ব্যগ্র। মনের স্বাধীনতা যেখানে থাকে না, সেখানে তিনি অগ্রসর হন না। তার বহু টাকা ক্ষতি হয়ে যাক, জীবনে দুঃখের মাত্রা বেড়ে উঠুক, অভাবের বেদনা তাকে চেপে ধরুক, তবুও তিনি তার চিত্তের অবমাননা সহ্য করতে পারেন না।
রাণা প্রতাপ যখন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পুত্র-কন্যাদি নিয়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় নিলেন, তখনকার অবস্থা একবার চিন্তা কর। যার সুখের অন্ত ছিল না, সম্মান রক্ষার জন্য তিনি কত দুঃখ ভোগ করেছিলেন। সম্রাট আকবরের কাছে একটু বশ্যতা স্বীকার করলেই তাকে এত কষ্ট পেতে হতো না। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব ও আত্মমর্যাদা জ্ঞান রয়েছে, তিনি জানেন fত্তর স্বাধীনতার মূল্য কত। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে মরে যাই সেও ভালো, তবু নিজের অমর্যাদা দেখতে ভদ্রলোক পছন্দ করেন না। বাদশাহ্ আকবর গুণগ্রাহী ছিলেন, তিনি রাণাকে সম্মান করেছিলেন। সম্রাট আকবর ভদ্রলোক ছিলেন। রাণাং ছিলেন ভদ্রলোক, তাই ভদ্রলোকের কাছে ভদ্রলোকের অবমাননা হয় না। হিন্দু হলেও রাণার মনের উচ্চতা কি মুসলমানের শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য নয়?
দু’টি পয়সার জন্য যিনি নীচতার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন না, নিজের সম্মানের কথা ভুলে একটুখানি ক্ষতি স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন, যার জীবনের মর্যাদা সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নাই, তিনি কীরূপ ভদ্রলোক? বহু ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার আত্মীয়তা আছে, অনেক বড় লোক তোমার বন্ধু, তোমার মাসিক আয় হাজার টাকা, তুমি গাড়ি ঘোড়ায় চড় কিন্তু তুমি কাপুরুষ, মানুষ অসন্তুষ্ট হবে, নিজের আর্থিক ক্ষতি হবে ভেবে তুমি সত্য প্রকাশ করতে ভয় পাও–তুমি কি ভদ্রলোক? জান না, নিজের মনুষ্যত্বের কাছে সংসারের অর্থ বৈভবের মূল্য এক পয়সাও নাই। অসত্য ও অন্যায়কে মেনে নেবার বেদনা ভদ্রলোক। কখনও সহ্য করতে পারেন না।
ভদ্রলোক জ্ঞানের সেবক। দুনিয়ার পণ্ডিতমণ্ডলীর সঙ্গে তিনি যোগ না রেখে পারেন; কোন মহাপুরুষ কী বলে গিয়েছেন, দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা কী নতুন কথা বলছেন, এ জানবার জন্য তার মনে একটা স্বাভাবিক ব্যাকুলতা থাকবেই। পুস্তক পাঠ করা, দেশের খবর রাখা তাঁর জীবনের একটা বড় কর্তব্য। সাংসারিক আপদ-বিপদে তাঁর মন অবসন্ন। হয়ে পড়ে, ব্যাধির প্রকোপ শরীরে স্ফুর্তি না থাকতে পারে, নানা প্রকার দুর্বিপাকে সময়ে সময়ে তিনি নিজেকে নিঃসহায় মনে করতে পারেন, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই জ্ঞানালোচনাকে তিনি বাদ দিতে পারেন না। এ তার রোগশয্যার পরম বন্ধু, দুঃখের মাঝে আশা, বিপদের সান্ত্বনা, ধর্ম জীবনের অবলম্বন।
জগৎ দেশ ও সমাজের যিনি খবর রাখেন না, চিন্তাশীল পণ্ডিতমণ্ডলীর চিন্তার সঙ্গে যার যোগ নাই, তিনি নিজের আভিজাত্যের গৌরব করতে পারেন। কিন্তু তার মূর্খ জীবনের মূল্য খুব কম। ভদ্রলোক যিনি পরিচয় দিতে যাবেন, তাকে বিচক্ষণ হতে হবে। বিশ্বের কোনো খবর রাখি না, জাতির চিন্তার সঙ্গে আমার কোনো যোগ নাই, নিজের চিন্তা নিয়ে ডুবে আছি, আমার জীবনের বিশেষ মূল্য কী? ভদ্রলোক যিনি তাকে জীবন ভরে শরীর পোষণ করবার সঙ্গে সঙ্গে আত্মাকেও খোরাক যোগাতে হবে। শরীরের স্বাস্থ্যই শুধু স্বাস্থ্য নয়। দীনহীন আত্মাকে ঘিরে যদি একটা মূল্যহীন শরীর বেঁচে থাকে, তবে তাতে আনন্দ করার বিশেষ কিছু নাই। দুর্বল শরীরের উজ্জ্বল আত্মা বহন করা বরং ভালো কিন্তু সুস্থ দেহে অন্ধ আত্মার ভার বহন করা বড়ই লজ্জাজনক। জীবনের বহু অভাবকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি, কিন্তু পুস্তক, জ্ঞানীগণের অমূল্য উপদেশ, চিন্তাশীল পণ্ডিতের চিন্তাকে বাদ দিয়ে আমরা কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারি নে। একদিন না খেয়ে থাকা উত্তম কিন্তু জ্ঞানীগণের সঙ্গে সংস্রব না রেখে জীবন কাটিয়ে দেওয়া ভদ্রলোকের পক্ষে নিতান্তই অশোভন। আমরা যেমন শরীরকে নিত্য আহার দিচ্ছি, আত্মাকেও তেমনি নিত্য জ্ঞানের খোরাক দিতে হবে। জ্ঞানের সঙ্গে যোগ না রেখে, যিনি হাসি-খেলা করে সংসারের সকল অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জীবনকে উড়িয়ে দিতে পারেন তিনি কীরূপ ভদ্রলোক।