ভদ্রলোক হও। বেশি কিছু দরকার নাই। সমুদ্র তরঙ্গ তুলে, ভয়াবহ মূর্তি ধারণ করে, প্রাণে ভীতি, বিস্ময় ও শ্রদ্ধা সৃষ্টি করে সত্য, কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শান্ত শীতল বারিস্রোতগুলির কি কোনো সার্থকতা নাই? তারা কল কল করে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যায়, ক্লান্ত পথিক অঞ্জলি ভরে তার সুশীতল জল পান করে।
মানব-জীবনে সহানুভূতি একটা শ্রেষ্ঠ গুণ। যিনি ভদ্রলোক তার প্রাণ সহানুভূতিতে ভরা থাকবেই। যিনি মানুষকে সহানুভূতি দেখাতে অভ্যস্ত নন, তাঁকে ভদ্রলোক বলতে মন কুণ্ঠা বোধ করে।
নিজের সুখ-দুঃখ, নিজের উন্নতি নিয়ে আমার চিত্ত সর্বদা ডুবে আছে, যাদের মধ্যে বাস করি, যারা সর্বদা আমার পাশে পাশে ঘোরে, যারা আমার প্রতিবেশী, যারা জীবন সংগ্রামে অনেক আঘাত সয়েছে, তাদের প্রতি কি কোনো কর্তব্য নাই? এ জগতে নিজের কথা নিয়ে সবাই ব্যস্ত, পরের কথা ভাববার মতো প্রাণ তোমার হওয়া চাই, পরের জন্য সর্বস্ব তুমি দান কর এ আমি বলছি নে। হাজী মহসীন বা ফরাসি দেশের প্রাতঃস্মরণীয় গেঁয়োর মতো ত্যাগ মহিমায় তোমার জীবন উজ্জ্বল হোক, এত বড় কথাও আমি বলতে চাইনে। আমি চাই তোমার প্রাণ নিজের মধ্যেই যেন ডুবে না থাকে। এমন করে আত্মাকে বিনষ্ট করে ফেললে তোমার মনুষ্যত্বের প্রতি খুবই অবিচার করা হবে। রেল স্টেশনে বিপন্ন। ভদ্রলোকের বাক্সটি যদি ধরে তুলে দাও, তাতে তোমার ক্ষতি হবে না; শহরের রাস্তায় অপরিচিত পথিককে হাসিমুখে তার পথের সন্ধান বলে দেওয়া তো দোষের নয়। পথের ধারে যে পড়ে গিয়েছে, তার ব্যথিত অঙ্গে হাত বুলিয়ে দেওয়া লজ্জার কথা নয়,–হোক সে যে-কোনো জাতির লোক।
ক্ষিপ্ত উন্মত্ত ঘোড়ার বন্ধু চেপে ধরে তুমি সাহসিকতার পরিচয় দাও–এও আমি বলছি নে! অপরের প্রতি অবিচার করে মানুষের দুঃখ-ব্যথার প্রতি উদাসীন হয়ে নিজের সুখ-সুবিধাটুকু আদায় করে নিতে ভদ্রলোক সবসময়ই লজ্জাবোধ করেন। এরূপ সুবিধা তাকে মোটেই আনন্দ দেয় না।
পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল যদি আমরা হই, তা হলে মানবসমাজের কত সুখ বেড়ে যায়! অপরের অভাব ও দুঃখ-ব্যথা যদি আমরা নিজের মতো করে অনুভব করতে না শিখি, তা হলে মানব সমাজের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবার ষোল আনা আনন্দ হতে আমরা বঞ্চিত হবো।
ভদ্রলোকের ব্যবহার দেখেই বুঝতে পারা যায়, তিনি কত উচ্চস্তরের লোক। তার কথা ও কাজ সর্বদাই সুন্দর। ধর্ম-জীবন তার স্বতন্ত্র নয়। এক শ্রেণীর লোক আছেন যারা ধর্ম জীবনকে নিজের কথা ও কাজ হতে স্বতন্ত্র করে গ্রহণ করতে চান। ধর্ম-জীবন অর্থ শুধু উপাসনা করা নয়! মানুষের সহিত ব্যবহার যদি নির্মল মধুর না হয়, তবে আমরা নিত্য যত রকমের জীবনের কাজ সমাধান করি, তা যদি অন্যায়ের কলঙ্ক হতে স্বতন্ত্র করে না রাখতে পারি, তা হলে আমাদের ধর্ম পালন ঠিক হবে না। যে জীবন পাপ, অন্যায় ও মিথ্যায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে তার ধর্ম কার্য করতে যাওয়া একটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই না। জীবনের কাজগুলিই এক প্রকার উপাসনা। যথার্থ ধার্মিক পুরুষ কি অভদ্র, নীচ, শঠ ও প্রতারক হতে পারেন? মানুষকে ঠকিয়ে তিনি কখনও মসজিদে যেতে সাহস পান না। ধর্মকে স্বতন্ত্র করে দেখা তখনই সম্ভব হয়, যখন মানুষের মনের অধঃপতন ঘটে। অনুন্নত চিত্তের মানুষ মনে করে খোদার দয়া ভিক্ষা করলেই তার সঙ্গে প্রেম করা হয়-এবাদত করলেই ধর্ম-জীবনের কর্তব্যগুলি শেষ হয়। আসলে তা হয় না। আল্লাহর সঙ্গে প্রেম করার অর্থ-আমাদের জীবনকে সর্ব প্রকারের কলঙ্কমুক্ত করে তোলা। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি কেন? আমার অন্যায়, আমার হীনতা, আমার পাপকে ঢাকবার জন্য। মানুষের মাথায় বাড়ি দেওয়া, পরের ঘরে সিদ কাটাই যে জঘন্য জীবনের একমাত্র নিদর্শন তা নয়। ধার্মিক মানুষকে খুব উঁচুতে উঠতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথা, মানব জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলি দিয়ে দীর্ঘ জীবনের ঘর গড়া হয়। ভাঙ্গা পুরানো ইট, খারাপ সুরকী দিয়ে যেমন ভাল ঘর হয় না, তেমনি ছোট ছোট অন্যায় কাজ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নীচ ব্যবহার আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ ও সুন্দর করে তুলতে পারে না।
ভদ্রলোক যিনি, তিনি ভদ্রলোকের সম্মান বুঝে থাকেন। ভদ্রলোক যেমন নিজের সম্মানও বোঝেন, অন্যের সম্মান ঠিক তেমনি করে বোঝেন। তার সম্মুখে যদি কোনো ভদ্রলোকের অপমান হয়, তিনি নীরবে তা সহ্য করতে পারেন না। বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে থাকলেও ভদ্রলোক ভদ্রলোকের বন্ধু। মুহূর্তের মাঝে তাদের মধ্যে পরিচয় হয়ে যায়। যে নীচ ও দুবৃত্ত, সে নিতান্ত আপনার জন হলেও ভদ্রলোক তাকে আপনার বলে স্বীকার করতে ইচ্ছা করেন না। নিজের অসুবিধা হলেও ভদ্রলোক ভদ্রলোকের সুবিধা করে দিতে আনন্দবোধ করেন। ভদ্রলোক চিরকালই গুণগ্রাহী। ছোট চিরকাল ছোট থাকবে। পাছে নিজের সম্মান নষ্ট হয়, এই ভয়ে ভদ্রলোক মানুষের গুণ স্বীকার করতে লজ্জা বোধ করেন না। তিনি ইচ্ছা করেন, যে গুণী তাঁর সম্মান ও আদর হোক। যেখানে গুণের আদর হয় না, যেখানে ন্যায়, সত্যের অসম্মান হয়, ভদ্রলোক সেখানে দুঃসহ দুঃখ বোধ করেন।
মানুষের মন যখন ছোট হয়ে যায়, যখন গুণ ও মনুষ্যত্ব অপেক্ষা বাইরের চাকচিক্যকে মানুষ বেশি সমাদর করে, তখনই সে অন্যায় লাভ করতে চায়। কোনো জাতির মধ্যে মানুষ যখন মানুষের গুণ স্বীকার করে না, অন্যায় ক্ষমতার জোড়ে উঁচু আসন অধিকার করে রাখে, তখন হতেই তাদের পতন আরম্ভ হয়। ছোটকে বড় করা, মানুষের মনুষ্যত্বকে সমাদর করা এবং প্রয়োজন হলে নিজে নিম্নসনে বসাই শ্রেষ্ঠ মানুষের কাজ।