তুমি যে জাতিই হও না, ভিন্ন জাতির লোকের প্রতি তোমাকে অভদ্র হতে হবে কেন? তোমার মনুষ্যত্ব তোমার জ্ঞান দেখেই মানুষ তোমার ধর্ম ও সমাজকে সম্মানের চোখে দেখবে।
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) যে এত মানুষকে মুসলমান করেছিলেন, সে কীসের বলে? তার মনুষ্যত্ব, তাঁর আশ্চর্য ভদ্রতা মানুষের মনকে মুগ্ধ করে দিত। বস্তুত হযরত মোহাম্মদের (সঃ) জীবনে তাঁর ভদ্রতা ছিল আশ্চর্য জিনিস। তাঁর স্নেহ তার সহনগুণ, তাঁর স্বভাবের অনন্ত মাধুরী মানুষকে পাগল করে দিত।
শুধু মুখের কথার মধ্যেই ভদ্রতা নিবদ্ধ নয়! ভদ্র ব্যক্তি সর্বদাই সহৃদয় ও স্নেহশীল। কাজেই তুমি সর্বদা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দাও, তোমার কথার কোনো মূল্যই নাই, স্বতন্ত্র হয়ে নিজের মতো নিজে বাস করাতেই তোমার আনন্দ হয়, প্রতিবেশী মারা গেলেও তুমি। সেদিকে ফিরে তাকাও না, তোমার ওষ্ঠের মৃদু-মধুর হাসি অভিবাদনের কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। বাইরেটা রূঢ় রেখেও যদি তোমার অন্তরের মানুষটিকে মধুর, সরল ও বিনয়ী করে তুলতে পারতে হবে তাই সুন্দর হতো।
কামান গোলা যত কিছুই আয়োজন কর না, তুমি তোমার জাতিকে পতন ও দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। জাতির মনুষ্যত্বই তার সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। যে জাতির মধ্যে নীচতা, হৃদয়হীনতা ও অজ্ঞানতা পরিপূর্ণ রকমে বিরাজ করছে, তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
মনুষ্যত্বকে যারা শ্রদ্ধা করতে শেখে নাই, তাদের স্বাধীনতা পাবার কোনো অধিকার নাই। মনুষ্যত্ব মানব জীবনের উচ্চাঙ্গের দ্ৰতা ছাড়া মূলত আর কিছুই নয়।
মানুষের প্রতি প্রেম, দেশের আর্ত-পীড়িতের প্রতি মায়া, অত্যাচারিত, ক্লিষ্ট মানুষের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি যার নাই, তিনি ভদ্রলোক নন। যে জাতির মধ্যে ভদ্রতা নাই, যারা পাপ ও অন্যায় করতে ব্যস্ত, তাদের বেঁচে থাকা না থাকা একই কথা।
জগতের এই যে কর্মব্যস্ততা, মানব-সুখের জন্য এই যে শত আয়োজন, এই যে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচার, সবার উদ্দেশ্য জাতির প্রত্যেক মানুষকে ভদ্র ও মানুষ করে তোলা। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে তিনি ভদ্র। মানবের কল্যাণ হয় কীসে? সত্য-সাধন নিয়ত মধুর বিনয়ী জীবনে। যে জীবনে ভদ্রতার পরশ নাই, সে যতই কোনো ধর্ম-কাজ করুক না, তার মূল্য খুব কম। সেই ব্যক্তিরই ধার্মিক বলে পরিচয় দেবার অধিকার আছে, যার অন্তর-বাহিরে ভদ্র, সুন্দর ও সত্য।
মানুষকে কোনো বিশেষ ধর্ম গ্রহণ করার জন্যে আহ্বান করে বিশেষ কোনো লাভ আছে কি না, ঠিক বুঝতে পারি না। মানুষকে সুন্দর, মহৎ ও প্রেমিক হতে বলাই বোধ হয় শ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারকের কাজ।
যে দুঃখ করে, যে ভয় করে, যে অনবরত হায় হায় করতে থাকে, তার অভিশপ্ত জীবন জগতে দুঃখ বর্ধন করে!
যদি পাপ-অন্যায়ে জীবন কলঙ্কিত হয়ে থাকে, যদি কারো প্রতি কোনো অবিচার করে থাকে, যদি সত্য পালন করতে পরাজিত হয়ে থাকে, তা হলেই তোমার দুঃখ হতে পারে! আর কোনো কারণেই তোমার মুখ ভার করবার দরকার নাই। অনন্ত মানুষকে নত মাথায় নমস্কার করে হাসি ও গানের আনন্দে তুমি জীবনপথে অগ্রসর হও। হিংসা পরশ্রীকাতরতা, অহঙ্কার তোমার ভিতর হতে দূর হোক। মানুষের বুকের সঙ্গে বুক লাগিয়ে প্রেম ও পুণ্যের গান গাও।
মানবজীবনে যতই দুঃখ-বেদনা থাক না, আনন্দের সঙ্গে তা বরণ করে নিতে হবে। মুখের হাসি চিত্তের স্ফুর্তি, সরল আলাপ, সকল বিপদ-আপদকে দূর করে দেয়। জীবনে নিরানন্দের কিছুই নাই-এ জীবন আনন্দ প্রবাহের একটা বিরাট বন্যা।জীবন-আকাশে মেঘের সঞ্চার হয়েছে, আল্লাহর নামে কেবল হাসতে থাক–ঐ মেঘ উড়ে যাবে।
সলোমন (Solomon) বলেছেন–যার প্রাণ স্ফুর্তিতে ভরা তার মুখোনি দেখলে প্রাণের গ্লানি দূর হয়। সে শুধু নিজের আনন্দে নিজেই মশগুল থাকে না; যারা তার আত্মীয়, যারা তার বন্ধু, তাদের প্রাণেও তাকে দেখে সাহস ও শক্তি আসে। উল্লাস ও আনন্দে যার প্রাণভরা সে শুধু আমাদেরকে বলে, জীবনে দুঃখের কোনো শঙ্কা নাই, মৃত্যুতে কোনো অশ্রু নাই–এস আল্লাহ্র নামে আমরা আমাদের দুঃখের বোঝা মাটিতে নামিয়ে রাখি; সকল। অবস্থায় সন্তুষ্ট থেকে তার আদেশগুলি পালন করি, মানুষকে যথাসম্ভব সুখ ও আনন্দ দেই।
আনন্দহীন জীবনের ভার বইবার মতো দুরবস্থা মানবজীবনে আর আছে কী? ব্যবসায়ে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, ঋণভারে মাথা নত হয়ে পড়েছে, মানুষের কড়া কথা শুনে প্রাণ অস্থির হয়ে উঠেছে, যা সম্পত্তি ছিল সব বেরিয়ে গিয়েছে, এসব ভেবে কাঁদলে চলবে না। যতদূর সম্ভব মানুষের কাছে নত হয়ে নিজের ত্রুটি স্বীকার কর, দীনাবস্থাকে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাক, হায় হায় করো না! তাতে কোনো লাভ হবে না জীবনের দুঃখ আরও বেড়ে যাবে–জীবন সমস্যার কোনই মীমাংসা হবে না।
আনন্দ-উৎফুল্ল মুখের শক্তি অসাধারণ, সমস্ত বিশ্বই তার বন্ধু। তার সকল বিপদের মীমাংসা হয়ে যায়। সে কারো সঙ্গে উগ্র হয়ে কথা বলে না। প্রতিবাদ করতে হলে সে কখনও ধৈর্য হারায় না, মানুষের মতের প্রতি সে শ্রদ্ধা পোষণ করে; কথায় ও ব্যবহারে সে কখনও দাম্ভিকতার পরিচয় দেয় না!
একটা মধুর কথা, একটু স্নেহের হাসি, ক্ষুদ্র হলেও মানুষের কাছে তা অতি বড় দান। মানব জীবনকে মধুময় করে তুলবার আর শ্রেষ্ঠ উপায় কী আছে, জানি না। দেশ ও জাতির মধ্যে একটা মহাবিপ্লব ও পরিবর্তন এনে নিজেকে শ্রেষ্ঠ করে তুলবার বাসনা করবার কোনো দরকার নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহানুভূতির উপহারে তুমি তোমার জীবনকে মধুর ও শ্রেষ্ঠ করে তোল, তাই তোমার পক্ষে যথেষ্ট। দেশপূজ্য মহাপুরুষ হবার কোনো দরকার নাই। তোমার ক্ষুদ্র সমাজে, তোমার ছোট গ্রামে, তোমার বন্ধু মহলে তুমি একজন আদর্শ