হয়ে উপায় কী? দুর্বল বা অনুগ্রহদগ্ধ জীবের পক্ষে বিনয়ে নম্র হওয়া ছাড়া পথ কৈ?
স্যার হেনরী সিনী তাঁর পুত্র ফিলিপ সিডনীকে বলেছিলেন, তুমি বড় বংশে জন্মেছ, বিনয় ও চরিত্র-মহিমায় তোমাকে তা প্রমাণ করতে হবে, তোমার সৎস্বভাব, তোমার বিনয় নম্র ব্যবহার, তোমার সত্য-প্রীতি; তোমার উচ্চকুলের পরিচয় দেবে। পিতার নাম করে যেন তোমাকে বড় বংশের লোক বলে পরিচয় দিতে না হয়। যদি ভীরু সঙ্কীর্ণহৃদয় ও নীচাশয় হও, তা হলে তোমার বড় বংশের কলঙ্ক হবে। পিতার এই উপদেশগুলি ফিলিপ সিনী গ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি যে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার তুলনা। পাওয়া যায় না। ভদ্রতার প্রধান উপাদান ত্যাগ। স্বার্থে প্রাণ পূর্ণ হয়ে আছে, পরের জন্য এতটুকু কষ্ট স্বীকার করতে মন চায় না, নিজেদের দাবি কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে খুব মজবুত, সব সময় নিজের সুখের সম্বন্ধে মন জাগ্রত; কিন্তু বাইরের লৌকিকতার খাতিরে প্রাণহীন ভদ্রতার পরিচয় দিচ্ছ, দেখা হলেই আদাব সালাম করে বিনয়ে মাথা অবনত করছ, এরূপ ভদ্রতার বিশেষ মূল্য আছে বলে মনে হয় না। পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার, নিজের সুখের সঙ্গে সঙ্গে পরের সুখের প্রতি দৃষ্টি রাখা, পরকে আঘাত না দেওয়া, অর্থ দিয়ে হোক বা পরিশ্রম করে তোক অন্যকে সাহায্য করবার নাম ভদ্রতা।
ছোট বংশে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের কি দ্ৰ হবার অধিকার নাই? সাধনার। সামনে কিছুই তো অসম্ভব নয়। মনের অহঙ্কার দূর করে দিয়ে, নিরপেক্ষ সমালোচক হয়ে। নিজেদের স্বভাবের প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখ, সেখানে যে ভুলটুকু আছে, চরিত্রের যে দৃঢ়তা আছে, তা ধীরে ধীরে দূর করে ফেল, জ্ঞান রাজ্য হতে সর্বদা বড় মানুষদের অমূল্য উপদেশগুলি পালন কর, তোমাকে কেউ ছোটলোকের ছেলে বলতে সাহস পাবে না।
মানুষ মানুষকে যে ঘৃণা করে, তার কারণ কী? যার মধ্যে মনুষ্যত্ব নাই, যে মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড, নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর, যার ব্যবহার মিথ্যার সঙ্গে জড়িত; বল দেখি লোক যদি তাকে ঘৃণা করে, তা হলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়? এ কথাও ঠিক, মানুষ মানুষকে অনেক সময় অন্যায় করে ঘৃণা করে। অন্যায় করে মানুষকে অত্যাধিক ঘৃণা করলে মনের অবনতি ঘটে।
ভদ্রঘরের ছেলেই যে ভদ্র হয়, এমন কোনো কথা নয়। প্লেটো খুব বড় ঘরের ছেলে ছিলেন না; তবুও জগতের পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে তার স্থান কত উঁচুতে। দার্শনিক ক্লিয়ানথাসের (Cleanthus) বাপ ছিলেন বাগানের মালী। ইউরোপিডিসের (Europides) বাপও ছিলেন মালী। জ্যোতির্বিদ পিথাগোরাসের (Pythagores) বাপ কামারের কাজ করতেন। ডিমসূথেনিসের বাপ ছুরি-কাচি তৈয়ার করতেন। কবি ভার্জিলের বাপ ছিলেন কুম্ভকার। কত রত্ন কত জায়গায় পড়ে থাকে; তার খবর কে রাখে? প্রতিকূল অবস্থার চাপে কত প্রতিভা কত মহৎ আত্মা অজ্ঞাত, অবজ্ঞাত হয়ে পৃথিবীর হতে বিদায় গ্রহণ করে। কবি গ্রে বলেছেন, সমুদ্রের অতল তলে কত মণিমুক্তা লোকচক্ষুর, অন্তরালে বালি কাদার মধ্যে পড়ে থাকে, কত গিরি-উপত্যকায় কত ফুল ফুটে আপন মনে। ঝরে পড়ে।
যে ছোট হয়ে পড়ে আছে, সে হয়তো ছোট নয়। তার মধ্যে কত মনুষ্যত্ব, কত মাধুরী ঘুমিয়ে আছে তা তুমি আমি না জানতে পারি, সুবিধা ও সুযোগ পেলে সেও মানব সমাজে সম্মান পেতো।
মানুষ যতই ছোট হোক, যতই সে অবজ্ঞাত হয়ে থাকুক, তার মধ্যে অসীম ক্ষমতা, অনন্ত প্রতিভা ঘুমিয়ে রয়েছে; অনুকূল বাতাস পেলে তার ভিতরকার রূপ ও মহিমা অনন্ত শিখায় ফুটে উঠবে।
জাতির ভিতরকার লক্ষ মৌন আত্মাকে ডেকে তুলতে হবে। যে জাতির মাঝে সাধারণ মানুষের সামনে মুক্তির পথ খোলা নাই, সে জাতি দিন দিন দুর্বল হতে থাকে। তাদের শক্তি সাধারণ পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
কতকগুলি ভদ্রলোক উচ্চবংশ নিয়ে জাতি কখনও গৌরবের পথে অগ্রসর হতে পারে। মানবসমাজে মানুষের ঘরে নিত্য নূতন আত্মা নবীন শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে, তাদের গতিপথ রুদ্ধ করে রাখ, তাতে জাতিই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আভিজাত্য গর্বের মূলে কিছু সত্য থাকলেও মিথ্যা বংশগৌরব এবং ছোটকে অবজ্ঞা করার পাপে দেশ ও জাতির সমূহ ক্ষতি হয়। যে ছোট সে যদি বড় গুরুর আসনে বসে, তাতে আনন্দ ছাড়া নিরানন্দের কোনোই কারণ নাই।
শেক্সপীয়ার ছোট-ঘরের ছেলে ছিলেন। বেন জনসন, ওয়াট, জাসিয়া ওয়েজউড Josea Wedgewood) নিম্নশ্রেণীর লোক হতে উদ্ভূত। বার্নস লাঙ্গল চষতেন। কীটসকে (Keats) ওষুধ বেচে জীবিকা অর্জন করতে হতো।
পণ্ডিত প্রবর কার্লাইল নিজেকে মিস্ত্রীর ছেলে বলে পরিচয় দিতে কোন দিন লজ্জা বোধ করেন নি বরং সে কথা বলতে তিনি বিচক্ষণ গৌরব অনুভব করতেন। মিস্ত্রীর ছেলে বলে কার্লাইলের বড় হবার পথে কোনো অন্তরায় আসে নাই।
ভদ্র যিনি তিনি সহজে ক্রুদ্ধ হন না, আঘাত পেলেও অনেক চিন্তা করে দেখেন, তাঁর কোনো অপরাধ হয়েছে কি না, মানুষকে ব্যথা দেওয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। দুঃস্থ মানুষকে দেখলে তার মনে বেদনা উপস্থিত হয়। তিনি সাধ্যমত পীড়িতের বেদনা দূর করতে চেষ্টা করেন। দ্র যিনি তার কথা বড় মধুর, প্রকৃতি অতি অমায়িক, ক্ষতি স্বীকার করেও নিজেদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন। যিনি সত্যপ্রিয়, তার কথা ও কাজের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না। পরনিন্দা করা তাঁর পক্ষে খুব কঠিন। তিনি সাধ্যমত কারো কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করেন না। সর্বদা প্রতিবেশী, বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনের সংবাদ দেওয়া তার স্বভাব। খোদার উপর নির্ভর করা তাঁর অভ্যাস। মানুষের মন খুশি করবার জন্যে তিনি অন্যায় কথা বলেন না। সৎসাহস তার স্বভাবের ভূষণ। তিনি ভদ্রতা দেখাবার সময় জাতি বিচার করেন না।