মানব-সমাজকে বাঁচাবার জন্যে অসীম প্রেমে, অনন্ত ব্যথা-অনুভূতিতে মহাপুরুষেরা পাগল হয়ে যান। তাদের বিরাট স্নেহের কল্যাণ আহ্বানে যারা সাড়া দেয়; তারা সৌভাগ্য লাভ করে।
আরব সমাজের পাপ–আর ব্যথিতের মর্মপীড়া মহাপুরুষ মোহাম্মদ (স)-কে কাঁদিয়েছিল–তিনি মানুষ মানুষ বলে পথে বের হয়েছিলেন।
যুবক বুদ্ধের প্রাণে মানুষের দুঃখ ও ব্যথা কী অসীম বেদনা সৃষ্টি করেছিলে–কত সুখ, কত বিলাস ত্যাগ করে ঘর ছেড়ে মানুষের দুঃখ ব্যথার মীমাংসার জন্য তিনি বনে বনে ছয় বৎসর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর শরীরের উপর দিয়ে গাছ হয়ে গিয়েছিল। কী বিরাট মনুষ্যত্বের গৌরব দিয়ে খোদা তাঁকে এ জগতে পাঠিয়েছিলেন।
মানুষ যখন মহামানবতার পরিচয় দেন, তখন কেউ কেউ তাকে খোদার আসন দিয়ে থাকে। এতে মহামানুষদিগকে অপমান করা হয়। নারায়ণ হয়ে মহাপুরুষদের মোটেই তৃপ্তি। হয় না, তাঁরা চান মানব দুঃখের অবসান, অসত্য ও মিথ্যার বিরুদ্ধে মানব-সমাজের বিদ্রোহ। মহাপুরুষেরা যদি মানবসাধারণের কাছ থেকে নারায়ণ উপাধি পান, তাতে তাদের জীবনের বিশেষত্ব নষ্ট হয়।
জীবনে মহৎ হয়ে লাভ কী? কেননা আমরা মানুষ। রাজা হবার দাবি একমাত্র মানুষেরই আছে। দুঃখ, পাপ ও অজ্ঞানের আঁধারকে দুই হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে। আমাদিগকে উধ্ব হতে ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। কী বিরাট আলোক, কী অফুরন্ত আনন্দের রাজ্য মানুষের সামনে, মানুষ তার গৌরব ভুলে কী করে আঁধার ও মৃত্যুর পথে হাঁটবে? মানুষকে। মহৎ করতে হবে কারণ মহৎ হবার জন্যই সে এ জগতে এসেছিল। দুঃখ-ব্যথা, মায়া প্রলোভনের ভিতর দিয়ে, সে যে কত বড়, তাই সে প্রমাণ করবে। মানুষ কত বড়, সে কী বিরাট, তার পক্ষে দুর্বলতার পরিচয় দেওয়া কত বড় বোকামি, তার কতখানি অপমান হয়। সারা প্রকৃতি মানুষকে কত বড় হবার জন্যে ডাকছে, উদার আকাশ, উষা। আলো বাঁশরীর রাগিণী, মানবকণ্ঠের সঙ্গীতধ্বনি, আর্তের অশ্রু মানুষকে কেবলই মহত্ত্বের পথে ডাকছে। মিথ্যা এ জীবন, এ সুখ, এ বিষয়-বৈভব। জীবনে যে সকার্য করা যায়, তাই মানুষকে তৃপ্তি দিতে সক্ষম। দালান-কোঠা, হাতি-ঘোড়া, শত শত বিলাস উপহার কিছুরই মাঝে মানুষের তৃপ্তি নাই।
রানী ভিক্টোরিয়া একবার একখানা মৃত্যুদণ্ডের আদেশপত্রে স্বাক্ষর করতে যেয়ে সজল নয়নে ডিউক অব ওয়েলিংটনকে জিজ্ঞাসা করেন–ডিউক সত্যই কি এই ব্যক্তির প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতে হবে? একে কি কিছুতেই রক্ষা করা যায় না?
ডিউক অপ্রস্তুত হয়ে বল্লেন–না মহারানী, এই ব্যক্তি তিনবার আইন অমান্য করেছে।
যার মৃত্যুর আদেশ দিতে হবে, সে ছিল একজন সৈনিক, সে তিনবার যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছিল। সৈনিকের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে যাওয়া গুরুতর অপরাধ, এতে প্রাণদণ্ড হয়।
মহারানী আবার জিজ্ঞাসা করলেন–তা হলে এই ব্যক্তির সপক্ষে কিছুই আপনার বলবার নাই? ডিউক বল্লেন–লোকটি সামরিক আইন অমান্য করলেও এর স্বভাব বড় ভালো।
দয়াবতী রানী তখনই কাগজের উপর লিখলেন এর প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রত্যাহার করা গেল।
হযরত আলীর (রাঃ) সঙ্গে এক ব্যক্তির লড়াই হয়েছিল। লোকটির গায়ে অসীম শক্তি ছিল, মুসলমান সাম্রাজ্যের খলিফাও কম শক্তিশালী ছিলেন না। হযরত আলী তাকে যখন মাটির উপর ফেলে হত্যা করবেন তখন সে হঠাৎ খলিফার মুখে থুতু ফেলে দিল। খলিফা তৎক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে বল্লেন–এখন যেতে পার, তোমায় আর আমি কিছুই করব না।
লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার এই ব্যবহারের কারণ কী? হযরত আলী (রাঃ) বল্লেন-ঘৃণা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে আমি তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করি নি। তুমি দুষ্ট, মানব সমাজের সমূহ অকল্যাণ করছিলে, তাই তোমাকে শাস্তি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলাম। যখন আমার মুখে তুমি থুতু দিয়েছিলে তখন আমার মনে ক্রোধ হয়েছিল। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আল্লাহ্র মানুষ আমি হত্যা করি নি। হযরত আলীর এই চরিত্র মহিমা মানুষের মনকে কত পবিত্র করে দেয়; আত্মবুদ্ধি কত উপরে টেনে তোলে।
গুজরাটের রাজা আহমদ শাহের জামাতা এক সময় একটা মানুষ খুন করেছিল। হত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনেরা যখন বিচারকের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করলো, তখন বিচারক ভাবলেন–জামাতার অপরাধের শাস্তি দিলে সম্রাট আমার উপর রুষ্ট হতে পারেন। এই চিন্তা তার বিবেক-বুদ্ধিকে দুর্বল করে দিল। তিনি নিজের আসনের অবমাননা করে বাদশাহের জামাতাকে বিশেষ কিছু শাস্তি দিলেন না। আহম্মদ শাহ যখন শুনলেন–তার দরিদ্র প্রজা ন্যায় বিচার পায় নি, তখন তার ভিতরকার মানুষ করুণ ঘৃণায় উত্তেজিত হয়ে উঠলো। তিনি বিচারককে ডেকে বল্লেন–সাহেব, বিবেক-বুদ্ধিকে অবহেলা করে ন্যায় বিচারকে অবমাননা করে আপনি কী করে আমার নরহন্তা জামাতাকে মুক্তি দিলেন?
বিচারক লজ্জিত হয়ে বল্লেন–সম্রাট, আপনার জামাতা বলেই তাকে কিছু বলি নি, অন্য কেউ হলে তাকে কঠিন শাস্তি দিতাম।
সম্রাট বল্লেন–এর নাম কি বিচার? আমি যদি অন্যায় করতাম তা হলে আমাকেও কি –আপনি আইন অমান্য করে মুক্তি দিতে পারতেন? আপনি আপনার সুবুদ্ধিকে-ভয় করুন, আমাকে ভয় করবেন না। পাছে আমি কী মনে করি, এই ভয়েই হয়তো অপরাধীকে শাস্তি দিতে আপনি কুণ্ঠিত হয়েছেন। আমি কাপুরুষ বা অত্যাচারী রাজা নই। যার স্নেহের ধনকে আমার জামাতা হত্যা করেছে–তার অশ্রুর কি কোনো মূল্য নাই?