মানুষের শ্রদ্ধার জন্যে লালায়িত হয়ো না, তুমি শুধু তোমার কাজ করে যাবে। সাধনা পথে শ্রদ্ধার সম্মানের জন্য লালায়িত হলে তোমার সাধনা পণ্ড হয়ে যাবে।
মনের চাঞ্চল্য ও ধৈর্যশূন্যতা মানুষের সমূহ অনিষ্টের মূল। বছরের পর বছর চলে যাক–পল্লীর শান্ত-শীতল গৃহের বারান্দায় বসে তুমি তোমার পবিত্র নিরীহ জীবন, তোমার কর্ম, তোমার জ্ঞানানুশীলনের সাধনা দিয়ে কাটিয়ে দাও। কি ব্যবসাক্ষেত্রে, কি শারীরিক পরিশ্রমে, কি পাঠকার্যে–কখনও ধৈর্য হারিও না। যেতে দাও বছরের পর বছর–তোমার জন্যে গৌরব অপেক্ষা করছে।
তোমার ছোট সুন্দর পরিবারকে নিয়ে দরিদ্র স্বচ্ছল অবস্থায় জ্ঞানরাজ্যের সঙ্গে যোগ রেখে যদি তুমি মরে যেতে পার–তোমার জীবন সার্থক হবে।
যেখানে আছ, সেখান হতেই তোমার যাত্রা শুরু হোক–এখান হতেই তুমি তোমার জীবনকে বড় করে তুলতে পার।–কোথাও যাবার দরকার নাই।
যে সমস্ত মানুষ বিদেশী মানুষের কাছে পণ্ডিত বলে উপাধি পেয়েছে তাদের যদি চরিত্রবল না থাকে, তাদের মন যদি সঙ্কীর্ণ ও নিষ্ঠুর হয়, তাদের কাছে যেয়ো না তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করো না।
যার চরিত্রবল নাই, মানুষকে যে ভালবাসতে জানে না, অভাব যার মোটে ঘোচে না, মানুষের কাছে হীন হয়ে সম্মান ভিক্ষা করে, সে অপদার্থ শিক্ষিত হলেও সে শিক্ষিত নয়। তোমাকে জাগতে হবে। পুনঃপুনঃ বলছিইচ্ছা হলে তুমি বড় হতে পার। তুমি জাতির সেবা করতে পার। তোমার হাতে মানবসমাজের বহু কল্যাণ হতে পারে, তোমার বিরাট আত্মা, তোমার পূত, শুভ্র, চরিত্র নিয়ে তুমি আজ ঊষার আলোর পথের দিকে তাকাও। সমস্ত গগন পবন আজ তোমায় ডেকেছে। এই জড় দেহের হীন ক্ষুধাগুলি আজ চূর্ণ করে ফেল। তোমার আত্মার কিরণ দুঃখ-দগ্ধ আর্ত-পাপ নর-নারীর কাছে শুভ ও কল্যাণ বয়ে নিয়ে যাক। আজ সকল পাপ-তাপ তোমা হতে খসে পড়ুক।
বাপ-মায়ের অন্ধ স্নেহ, আত্মীয়-বান্ধবদের চিন্তাশূন্য মন্তব্য তোমার আত্মাকে যেন দুর্বল না করে ফেলে। মানুষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দেবার জন্যে এই দুটির মতো পরম শত্রু আর নাই।
তুমি নিজেকে কখনও নিঃসহায় ও দরিদ্র মনে করো না। যেদিন তুমি জন্মেছিলে সেদিন আল্লাহ্ তোমাকে দু’খানি হাত, দুখানি পা আর একখানা মাথা দিয়েছিলেন–মানব জীবনের পক্ষে এই-ই যথেষ্ট সম্বল।
৩. ভদ্রতা
যুক্তরাজ্যের নায়ক এক সময় ভ্রমণে বার হয়েছিলেন। তাঁর গাড়িতে মোটে স্থান ছিল না–লোকের ভিড় খুব বেশি হয়েছিল। এমন সময় একটা নিগ্রো রমণী সেই গাড়িতে উঠলে, দেশনায়ক অমনি উঠে দাঁড়িয়ে সেই সামান্য নারীকে বসবার স্থান দিলেন। বাকি পথটুকু তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন।
রাষ্ট্রনায়কের এই ভদ্রতা কি মহত্ত্বের পরিচয় নয়? রমণীটি নিম্নশ্রেণীর তাকে সম্মান করে বিশেষ লাভ কী! তার মতো সামান্য স্ত্রীলোকের পক্ষে দেশনায়কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই ভদ্রতা, এই সব চিন্তা রাষ্ট্রপতির মাথাকে অস্থির করে নি Lহোক না সে পথের নারী, নীচ বংশোদ্ভবা তাতে কী আসে যায়! নীচ বলে, ছোট বলে, ভদ্ৰ ব্যবহার করতে দেশনায়ক লজ্জাবোধ করেন নি।
রেলগাড়ির দুয়ারের কাছে কোনো লোক এলে সবাই যদি হেঁকে বলি–স্থান নাই, তাতে মোটেই ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া হবে না। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, আমি যদি জায়গা জুড়ে বসে থাকি–তাতেও বিশেষ মহত্ত্ব বা মনুষ্যত্ব দেখান হবে না।
যিনি ভদ্রলোক, তিনিই ভদ্রতার পরিচয় দেন। একটি কঠিন কথা বলে তো প্রাণে আনন্দ অনুভব করবার কিছু নাই।
সারাদিন পরিশ্রম করে বড় ক্লান্ত হয়েছ, একটা অবোধ মানুষ এসে তোমাকে বিরক্ত করছে, তাই বলে কি তাকে কঠিন কথা বলবে? ডাকঘরে, বাজারে, কাঁচারীতে অথবা থানায়, যেখানে তুমি থাক না, তোমাকে সব জায়গাতেই দ্র ও মধুর-স্বভাব হতে হবে।
ডাকঘরে কাজ কর, ভিতরে পাখার নিচে বসে মনে মনে যেন ক্ষমতার গর্ব না আসে, বাইরের লোকগুলির উপর যেন কোনও রকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করবার প্রবৃত্তি তোমার না জাগে।
থানা-ঘরের চারিদিকে তোমার হুকুম তামিল করার জন্য সিপাইরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তোমার ইঙ্গিতে ওরা মানুষ পর্যন্ত খুন করে ফেলতে পারে, কিন্তু তবু তোমাকে নম্র ও মধুর স্বভাব হতে হবে, কারণ তুমি ভদ্রলোক। কারণ ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করিতে তুমি লজ্জাবোধ কর, বিনয়ে মধুর হয়ে মানুষের সঙ্গে দ্র ব্যবহার কর, চোর বদমাইশকে শাস্তি দাও কর্তব্যের খাতিরে–ক্রোধ বা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে নয়।
এ জগতে উগ্র হয়ে দুর্বলকে কঠিন কথা বলবার অধিকার কারো নাই। মানুষ সব সময়ে দরিদ্র, এ জগতে এতটুকু অহঙ্কার করবার সুযোগ আমাদের নাই। মাথা নত করে কর্তব্যের আদেশ মেনে জীবন-পথের অগ্রসর হতে হবে।
এমার্সন বলেছেন–একটা সুন্দর মুখের চেয়ে একটা কুৎসিত মুখের মধুর কথা অধিকতর সুন্দর। সত্যই তো সুন্দর সুশ্রী মুখ আমাদের চিত্তকে আনন্দ দান করে না। মধুর জ্ঞানপূর্ণ সরলপূর্ণ সরল আলাপে কাফির জঘন্য চেহারাও আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে।
জনসন দ্ৰতা জিনিসটাকে মোটেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু তবু তিনি ভদ্রতার পরিচয় দিতেন, যা শুনলে বিস্মিত হতে হয়। যে ভদ্রতার মনের সঙ্গে যোগ নাই, তাই হয়তো তিনি ভালবাসতেন না।
পরাধীন দেশের মানুষ সব সময়ে যথার্থ বিনয়ের পরিচয় দিতে সক্ষম হয় না। অভাব ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ভদ্রতাও অনেক সময় খাঁটি হয় না। যাকে মানুষের ভয় করে চলতে হয়, তার পক্ষে সব সময় সভ্য ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। জীবনের এই কঠিন কলঙ্ক হতে মানুষকে সব সময় মুক্ত হতে চেষ্টা করতে হবে। কারণ এ অবস্থাটা আত্মার। পক্ষে খুবই অপমানজনক। স্বাধীন মুক্ত মানুষের ভদ্রতাই প্রকৃত ভদ্রতা। দরিদ্রের পক্ষে ভদ্র।