ছোট লোকের ছেলে ছোট হয়, লোকে এ কথা বলে থাকে। মানুষ যাদের মধ্যে বাস করে, তাদের চিন্তা, প্রবৃত্তি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা মনের উপর বড়ই ক্রিয়া করে সত্য! পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমাদের আত্মাকে চেপে মেরে ফেলে। কিন্তু মানুষ কখনো এ জগতে ছোট হয়ে আসে না। যদি সুবিধা ও সুযোগ থাকে, তা হলে হীন মানুষের ছেলেও কালে বরেণ্য হতে পারে। মানুষই মানুষকে ছোট ও নিচু করে ফেলে। যে শিশু পিতা-মাতা, বন্ধু বান্ধব, দেশ ও সমাজের মানুষের কাছে জীবনে বড় কথা শোনে না, সে কেন বড় হতে চাইবে? কু-কাজ করে হীনতার পরিচয় নিয়ে আমরা চারদিককার সবাইকে যদি গৌরব করতে শুনি, তা হলে আমার দুর্বল মন ধীরে ধীরে নিচ হতে থাকবে না কেন?
সাহিত্যের কাজ মানুষকে তার চারদিককার মন্দ-শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলা, তার মধ্যে সমাজ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাহ্য করে ন্যায়, সত্য ও আল্লাহূকে মেনে নেবার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে দেওয়া।
নিজের সুবিধার জন্যে সন্তানকে নিচ ও পাপ করতে প্ররোচনা দিও না। সেতো তোমার সন্তান নয়, সে এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে, আল্লাহ্র কাজ করবার জন্যে। তুমি তার সাধনা পথের সহায় হও, তার বিবেক ও সুবুদ্ধির উপর হাত দেবার কোনো অধিকার তোমার নাই।
ক্রমওয়েল প্রথম জীবনে একটা মেঠো চাষা ছিলেন অথচ শেষ জীবনে তার শক্তিতে বিলেতের শাসনতন্ত্র একেবারে ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। ক্রমওয়েলের জীবন-সাধনা ইংরেজ জাতির ইতিহাসের পৃষ্ঠাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে।
নেপোলিয়নের প্রিয় ঐতিহাসিক জেনারেল জেমিনী প্রথম জীবনে কোম্পানির কাগজের দালাল ছিলেন। কাপ্তান কুক সুচ সুতা বেচতেন।
দার্শনিক ব্রাউন ছিলেন তাঁতী! প্রাণিতত্ত্ববিদ আলদ্রভিনদা প্রথম জীবনে জনৈক ভদ্রলোকের বালক ভৃত্য ছিলেন। জ্যোতির্বিদ পিকার্ড যখন বাগানের মালী ছিলেন, তখনই তিনি সাধনার পথ ঠিক করে নিয়েছিলেন। এঁরা প্রথম জীবনে খুব ছোট কাজ করতেন। এই ধরনের ছোট কাজ আমাদের দেশে যদি কেউ করে, লোকে তাকে ছোটলোক বলবে। ছোট লোকদিগকেই মানুষ হতে হবে। জাতির প্রাণ এরা। জাতিকে এরাই ধ্বংস করে, এরাই বাঁচিয়ে তোলে।
যে ছোট হয়ে আছ, সে নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য দুঃখ করো না। তোমার মস্তিষ্ক ও শরীর নিয়ে তুমি তোমার বড় হবার পথ মুক্ত করে নিতে পার।
তুমি সামান্য কাজ করছ? তোমার জীবনকে জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের গৌরব দিয়ে বড় করে তুলতে চাও? তা হলে বন্ধু-বান্ধব ও মানুষের উপহাসকে উপহাস করে জ্ঞানের আলোচনা করো। বিদেশী ভাষা পড়বার দরকার নাই–বিদেশী ভাষা জানলে মানুষের সম্মান বাড়ে এ কথা ভাববার দরকার নাই। তুমি তোমার নিজের ভাষার ভিতর দিয়েই চরিত্রবলে, সৎসাহসে ও বুদ্ধিতে বড় হতে পার! দেশের মানুষের কাছে তোমার সম্মান হবে। মানুষ তোমার স্পর্শে এসে সুখী হবে।
তুমি খেলা করে, শুধু মানুষকে সেলাম জানিয়ে, বড় মানুষকে মিথ্যা তোষামোদ করে কেন তোমার জীবনকে বিফল করে দিচ্ছ?
বিলেতে এবং অন্যান্য দেশে বহু মানুষ জীবনের প্রথম অবস্থায় খুব ছোট ছিলেন। উত্তরকালে পরিশ্রম ও জ্ঞান সাধনা দ্বারা তারা দেশের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন।
শুধু নভেল পাঠ করলে তোমার শিক্ষা পূর্ণ হবে না, নভেল, উপন্যাস, কাব্য-কবিতা তোমার মনে শক্তি, সাহস, সুবুদ্ধি ও উদ্যম আনতে পারে, কিন্তু মানবজীবন শুধু শক্তি, সাহস, উদ্যম আর সহানুভূতিতে বেঁচে থাকবে না। শক্তি আছে, কিন্তু সে শক্তি প্রয়োগ করবার পন্থা তুমি জান না; তোমার সাহস আছে, তোমার উদ্যম আছে, তোমার প্রাণে প্রেমও আছে–কিন্তু অস্ত্রহীন হয়ে সাহসী হয়ে লাভ কী? অন্ধ হয়ে উদ্যমশালী হয়ে কী ফল? হীন হয়ে প্রাণে প্রেম পোষণ করলে মানব-দুঃখের অবসান হবে না।
মনুষ্যত্ব, সৎসাহস ও চরিত্রবল অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তোমার দেশের আইন, বর্তমান জগতের অবস্থা জমাজমি সংক্রান্ত মোটামুটি জ্ঞান, হিসাবপত্রের জ্ঞান–এসব শিখতে হবে, নইলে তোমার মনুষ্যত্ব ও জ্ঞান অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে যাবে। তোমার চেয়ে ছোট যারা, তাদের কাছে তোমাকে বোকা ও অপ্রস্তুত হতে হবে।
জীবনে ধনী লোক হতে পার আর না পার, জগতে বড় হতে চেষ্টা কর।
তোমার যদি বড় অভাব হয়ে থাকে–মানুষের দুয়ারে হাত পেত না। শারীরিক পরিশ্রম কর, ছোট ব্যবসা করে যদি সে অভাবের মীমাংসা হয়–লজ্জা করো না, সেই ছোট কাজ করেই তোমার অভাবের মীমাংস কর। তোমার পত্নী, তোমার মা, তোমার ছেলে মেয়েগুলিকে তুমি সুখ দাও। তোমার এ দীন জীবন দেখে আমি তোমায় ঘৃণা করব না।
এই ছোট কাজ করার সময় সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখতে হবে। তাদের বই তোমার পড়তে হবে। তোমাকে তোমার পত্নীকে, তোমার মা, তোমার বোন, তোমার কন্যা, তোমার প্রতিবেশী সকলকে ভালো কথা শুনাতে হবে। যে উপন্যাস চিত্তকে মার্জিত ও রুচিসম্পন্ন করে, সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিতে সমর্থ, চিত্তকে বিনয়ী, কোমল ও মধুর করে তোলে, যা আত্মার পশু-ভাব চূর্ণ করে প্রেমের মর্যাদা শিক্ষা দেয়–যা নারীর সুষমা সৌন্দর্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়–সে উপন্যাস পড়তে পারো। নানা দেশের ইতিহাস বিজ্ঞানের বই, জগতের মহামানুষ ও পণ্ডিতদের জীবনী এসব তোমাকে পড়তে হবে।