শিবনাথ শাস্ত্রী প্রত্যহ বিশ ঘণ্টা করে পড়তেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ঘুমে পড়া নষ্ট হবে এই ভয়ে বালিশ মাথায় দিতেন না।
মাইকেল এঞ্জেলো কাজ না করতে পারলে অস্থির হয়ে যেতেন। কোনো কোনো সময়ে দুপুর রাত্রে জেগে উঠে তিনি কাজ শুরু করে দিতেন।
অর্থ পাবার লোভেই সকলে কাজ করে না। কাজ সবাইকে করতে হবে। সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দেশের মানুষের উন্নতির জন্যে কাজ করা দরকার। সম্রাট ষোড়শ লুই একখানি বই উৎসর্গ পাবার সম্মানের লোভে স্পিনোজাকে পেন্সন দিতে চেয়েছিলেন। স্পিনোজা চশমার পাথর সাফ করে জীবিকা অর্জন করতেন। সম্রাটের এই দান তিনি গ্রহণ করেন নি,–বইও উৎসর্গ করেন নি। তিনি এত পড়তেন যে কোনো সময় তাঁকে অনবরত দুই-তিন দিন ধরে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে দেখা যেত। হাঙ্গেরীর জনৈক গণিতজ্ঞ গ্রীষ্মকালে দুই ঘণ্টা এবং শীতকালে চারঘণ্টা মাত্র শুতেন। বেলী প্রত্যহ চৌদ্দ ঘণ্টা করে চল্লিশ বৎসর ধরে পরিশ্রম করেন।
যে জাতির মানুষ শ্রমশীল, যারা জ্ঞান-সাধনায় আনন্দ অনুভব করে তারাই জগতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে। কর্তব্যজ্ঞানহীন নীতিজ্ঞানশূন্য আলসে মানুষের স্থান জগতে সকলের নিচেই হয়ে থাকে। তারা জগতে অবজ্ঞার ভার, অসম্মানের অগৌরব নিয়ে বেঁচে থাকে। জগতে ধন-সম্পদ জয় করতে হলে, জীবনের কল্যাণ লাভ করতে হলে, পরিশ্রম ও সাধনা চাই।
কিছুদিন আগে চিৎপুর রোডের একটা দোকানে এক টুপি বিক্রেতাকে একটা ছোট ঘরে বসে একখানা ইংরেজি নভেল পড়তে দেখেছিলাম। আমার একটু আশ্চর্য বোধ হয়েছিল। যারা লেখাপড়া না শিখে আরামে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে তারা তো বই পড়বার ধার ধারে না। তারা মনে করে এগুলি বাজে কাজ। কবে সেই দিন আসবে, যেদিন দেখতে পাব গাড়োয়ান ও কোচোয়ান বই খুলে পড়ছে, নাপিতের দোকানে রাজনীতি আলোচনা হচ্ছে।
জাতির হাজার হাজার মানুষের জীবনকে মৃত্যু হতে বাঁচাবার উপায় কী? দেশের লক্ষ মানুষ শরীরে বেঁচে থাকলেও তারা মরে আছে। যে জাতির এত মানুষ মরে আছে, সে জাতি অতি শীঘ্রই শেষ সমাধি লাভ করবে, এতো কবির কল্পনা নয়। জেলখানায়, রাজদরবারে, রান্না ঘরে বা রাস্তার বিপরীতে, পাহাড়ের মাথায় অথবা সমুদ্রের উপর যেখানেই থাক না জ্ঞানরাজ্য হতে রত্ন মাণিক আহরণ করে তুমি তোমার জীবনকে সার্থক কর! তোমার কল্যাণের পথ তোমার হাতেই রয়েছে। কেন ভিক্ষুকের সঙ্কোচ নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছ? স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট না পেলে তোমার জীবনের মূল্য হবে না, কে তোমাকে একথা বলেছে? মানুষ তোমার সার্টিফিকেট দেখবে না, দেখবে তোমার জ্ঞান, তোমার মনুষ্যত্ব, তোমার নৈতিক বল, তোমার চরিত্র। মানুষ তোমার দুর্জয় শক্তির সামনে লুণ্ঠিত হবে–এ তুমি বিশ্বাস কর। তোমার উকিল মোক্তার বা স্কুলের মাস্টার হবার দরকার নাই, সুতরাং সার্টিফিকেট না হলেও তোমার চলবে। চাই তোমার মনুষ্যত্ব ও প্রাণশক্তি জাগরণ–পরিশ্রম করার ক্ষমতা। হযরত মোহাম্মদ (সঃ), ঈচ্ছা (আঃ), বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ এরা কি প্রবেশিকা অথবা বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সত্য প্রচারের শক্তি অর্জন করেছিলেন?
কলেজে যেতে পার নি, তুমি ইংরেজি জান না। তাই বলে তোমাকে মানুষ হতে কে নিষেধ করেছে? কাপড় বেচতে বেচতে কি তুমি বিজ্ঞানের আলোচনা করতে পার না? চাউলের বস্তার কাছে কি তুমি একখানা ভালো বই রেখে দিতে পার না? কেন গর্ধভের মতো সিঁথি তুলে জীবনকে ব্যর্থ করে দিচ্ছ? কাপড় বেচতে অসম্মান হয় না, তুমি যে জ্ঞান-দরিদ্র, তুমি যে অবোধ, তোমার মনুষ্যত্ব নাই, তোমার চরিত্রবলের অভাব, তুমি নিষ্ঠুর ও কটুভাষী; এতেই তোমার অপমান, অন্য কারণে নয়। জ্ঞান আহরণ ব্যতীত মানুষের কী করে কল্যাণ হবে? মানুষ না হয়ে পশু হয়ে বাঁচতে আনন্দ কোথায়? শুধু রাজনৈতিক শিক্ষায় মনকে আবেগ আকুল করে তুললে চলবে না। তোমার চরিত্রবান হওয়া চাই, তোমার মানুষ হওয়া চাই, কারণ তোমার মনুষ্যত্ব, চরিত্রবলের উপরই তোমার এবং তোমার জাতির বড় হওয়া নির্ভর করে। সমাজসেবক হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছ, কিন্তু তুমি সামান্য একটু স্বার্থ ত্যাগ করতে পার না–তুমি অনাথিনী বালিকার অশ্রুকে উপহাস কর, মূঢ় তুমি। ধর্মের অর্থ বিশেষ কোনো মতে বিশ্বাস নয়–ধর্মের অর্থ মনুষ্যত্ব, জীবনের পবিত্রতা, ন্যায়নিষ্ঠা, আত্মার বিনয় ও দৃষ্টি।
এক এক কাজে এক এক জনের বিশেষ মন থাকে। যে কাজ মন চায়, তাই করা উচিত–সেই কাজে শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে জীবনকে সার্থক করতে হবে। জগতের প্রত্যেক কাজে, জীবনের প্রত্যেক সাধনার মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়া যায়। উকিল, ডেপুটির কাজ অপেক্ষা কাপড় বিক্রেতার মর্যাদা খুব কম, তা আমি মনে করতে পারি না। এক মহা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমরা অনন্ত মানুষ অনন্ত পথে অগ্রসর হচ্ছি, কাকে তুমি ঘৃণা করবে? মিস্ত্রীর নীরস বাটালির আঘাতে, রজকের কাপড়ের পাটের শব্দ, পণ্ডিতের সুললিত শ্লোকে–আমি শুনেছি একই গান। কাকে বলব, তুমি ছোট। কাপড় বিক্রেতা তার মোটা কাপড় দিয়ে দীন-দুঃখীর সেবা করতে পারে না? তার দীন উপহারে সতী বালিকার লজ্জা নিবারণ হয় না? এগুলি ছাড়া এবাদত কাকে বলে, তা আমি বুঝি না। তুমি বড় সাহিত্যিক, তুমি বড় বৈজ্ঞানিক, দিকে দিকে তোমার যশ ও গৌরব ছড়িয়ে পড়েছে, তুমি শ্রেষ্ঠ কবি, প্রকৃতি মুখর হয়ে তোমাকে কেবল গান জোগাচ্ছে, মানুষ তোমাকে দেখে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ওসব দেখে আমার মনে তৃপ্তি আসে না। দীন নয়নে একটা কটাক্ষ তোমার প্রাণকে চমকিত করে তোলে কিনা? শিশুর হাসি তোমার প্রাণে আনন্দ আনে কিনা? দুঃখীর নয়নজল তোমার কর্মনিরত হাতখানি একটু কাপিয়ে তোলে কি না? তোমার গ্রামে সেই একটা দুঃখী নারীর সিক্ত চোখের স্মৃতি তোমার বুকে লেগে রয়েছে কি না? অভাগার করুণ চিৎকার তোমার কানে আশে কিনা? যদি বল আমার সময় নাই, আমি কত বড় ব্যস্ত, আমি দেশসেবা করতে যাচ্ছি, আমার চিন্তার মধ্যে কেউ বাধা দিও না, আমি বলব তোমার বিজ্ঞানের হাড়গোড়গুলি সমুদ্রজলে ফেলে দাও–তোমার কবিতার বইগুলি পুড়িয়ে ফেলো–তোমার দেশসেবার দরকার নাই, আমার জন্যে তুমি লড়াই করতে যেয়ো না। দেশসেবার নামে যেদিন সুলতান প্রথম বায়েজীদ তার নিরপরাধ ভাইকে নিষ্ঠুরের মতো হত্যা করলেন, সেদিন আল্লাহ্ নীরব ভাষায় বলেছিলেন, এর নাম দেশসেবা নয়। অবিচার করে রাজকর্ম পালন করার দরকার নাই। নিষ্ঠুর প্রাণ হয়ে কবিতা লেখবারও কোনো প্রয়োজন নাই।