হযরত দাউদ (আঃ) নিজ হস্তে উদরান্নের সংস্থান করতেন। হযরত ঈছার (Jesus Chirst) (আঃ) কোনো চাকর ছিল না। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) পানি তুলতে গিয়ে ইহুদির হাতে চড় খেয়েছিলেন। ক্ষুধার তাড়নায় হযরতের পরিবার যখন ব্যাকুল, তখন তিনি পয়সা উপায় করতে গেলেন ইহুদির পানি তুলে। তিনি বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধার করতে যান নি। কাউকে নিজের অভাবের কথা বলতেও যান নি। বড় বংশের ছেলে বলে পানি তুলে পয়সা উপায় করতে লজ্জা বোধ করেন নি। মূর্খেরা বাহ্য অনুকরণ করেই মনে করে যে সুন্নত। হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর কাজের অনুকরণ পালন করা হল, কিন্তু মহানবীর দীনতা, তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, তাঁর সৎসাহস, তাঁর মহামানবতা, তার নৈতিক বল অনুকরণ করার জন্য তাদের কোনো আগ্রহই নাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা যে মহানবীর জীবনের বিশেষত্ব, সে বিশেষত্ব তোমার মধ্যে কই? সময়ের পরিবর্তনে মানুষের আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন হয়, জগতের রুচি ও সভ্যতা পালন না করে চললে, লোকের কাছে তোমার শিক্ষা-দীক্ষা ও মনুষ্যত্বের আদর হবে না। পাপকে ধ্বংস করা, ন্যায়পরায়ণ হওয়া, জ্ঞান আলোচনা করা, মানুষের প্রতি প্রেম পোষণ করা–এসব মহাসত্যের কোনো কালে পরিবর্তন হবে না। মানুষেরা চান–তোমাদের পবিত্র জীবন, তোমাদের মনুষ্যত্ব, তোমাদের চরিত্র।
ঘুষ খেয়ে, মানুষের উপর অত্যাচার করে যে বাড়িতে দালান দিয়েছে, ধিক তার জীবন। ধিক সেই অপদার্থ মানুষগুলিকে, যারা তাদের সম্মান করে। বাইরের চাকচিক্যের মধ্যে কী সম্মান বিদ্যমান? শুভ্র, সুরুচি সঙ্গত পোশাক এবং দেশের অবস্থা ও শিল্প বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে মূল্যবান সাজসজ্জা বেশি করে পরলে দোষ হয় না কিন্তু তাই বলে কী সেগুলি চুরি করে পরতে হবে?
পোশাক পরে মনে যদি বিন্দুমাত্র অহঙ্কার আসে, তবে সেগুলি ফেলে দাও। আল্লাহ্র কাজ করবার জন্য সুবিধার নিমিত্ত অনেক সময় পদ-মর্যাদার নিদর্শনস্বরূপ ভাল পোশাক আবশ্যক হয়; কিন্তু সত্য জীবন অবলম্বন করতে যেয়ে যদি সেগুলি না জোটে, তাতে বিশেষ কী আসে যায়? মহর্ষি টলস্টয় এত বড় লোক হয়েও খালি পায়ে বেড়াতেন, মহর্ষি জনসন নোংরা পোশাকে থাকতেন। তোমাদের শুভ্র পোশাকের পূর্বে চাই তোমাদের শুভ্র আত্মাটি–তোমার চিত্তের স্বাধীনতা–তোমার মনুষ্যত্ব।
পরিবারের মান-মর্যাদা বজায় রাখবার জন্য পোশাক পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, ডিস বর্তন, দাস-দাসী আবশ্যক, কিন্তু অবোধ জিজ্ঞাসা করি–মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে এই পদমর্যাদার মূল্য কী? যে তস্কর, যে পরস্বার্থহারী দস্যু, তার পত্নীর গায়ে সোনার গহনা, তার ছেলেদের গায়ে জরির পোশাক দেখলে মনে কি ঘৃণা হয় না?
লোকে কী বলবে? ওরে পাগল! জীবনকে পাপ, অন্যায় ও অজ্ঞানের আঁধার দিয়ে কলঙ্কিত করে ফেলছো তা তো ভাব না! ভাব লোকে কী বলবে? অন্যায় করে, চুরি করে নিজেকে সাজাতে পাচ্ছ না বলে ভাবছ লোকে কী বলবে?
মানুষের সমালোচনাকে একেবারেই উপেক্ষা কর, সৎ উপায়ে পয়সা অর্জনের জন্য যে কোনো কাজ কর। লজ্জায় যখন মুখ কাল হয়ে আসবে তখন মহাপুরুষের জীবনের কথা ভেব। কাজে কখনও মানুষের অপমান হয় না। অপমান হয়–অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকায়, অসত্য জীবনযাপনে, দরিদ্রকে সাহায্য করতে না পাড়ায়, দাম্ভিক ও অহঙ্কারী হওয়ায়।
যদি সম্মান চাও, তা হলে মানুষের দুয়ারে কুল-মর্যাদা ভিক্ষা না করে জ্ঞানের সেবা কর। জ্ঞানের বজ্রবাণ দিয়ে তুমি আভিজাত্যের মাথা ভেঙ্গে ফেল। কাজ কর, পরিশ্রম কর, কারো কাছে ঋণী হয়ো না! আমি কারো ধার ধারি না, কাউকে ধার দেই না, এসব কথা। বলে মানুষের কাছে গর্ব করা কিন্তু নিষেধ। অপদার্থেরা তোমাকে সম্মান করুক না করুক, তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। আমরা তোমাকে সম্মান করবো। তোমার ছোট সরল। জীবনকে দেখে তোমার কাছে কেউ না আসুক কোনো ক্ষতি নাই। অসত্যের উপাসক, দুষ্ট, বদমাইশ লোককে বেশি সম্মান প্রদর্শন করো না।
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “কেউ যদি কাপড় কেনে আর তার দেওয়া দামে যদি অন্যায়ের পয়সা থাকে, তা হলে সে কাপড় পরে সে যেন নামাজ না পড়ে।”
দরিদ্র সরল কৃষক, কামার, দর্জি, মিস্ত্রী, স্বর্ণকার, ক্ষৌরিক ও মুচি হও, সেও ভালো, তবু অসত্য জীবনযাপন করে ভদ্রলোক হতে চেও না। চিত্তের স্বাধীনতা হারিয়ে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে মানুষের কৃপা ভিক্ষা করে জীবনকে ব্যর্থ করে দিও না।
এ কথাও বলে দিচ্ছি, যে সত্য পথ অবলম্বন করে, যে বিনয়ী ও সত্যবাদী জ্ঞান পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগ রাখে, যে পরিশ্রমী, সে দরিদ্র হয়ে থাকবে না। সে বড় হবেই; তার দৃঢ়তা, তার সৎসাহস তার নৈতিক বলের পুরস্কার সে অবশ্যই পাবে।
অনবরত কাজ করে বিপুল অর্থ উপার্জন, তোমার এই পরিশ্রমের কোনো মূল্য নাই। কলিকাতার আদিম অধিবাসী কোনো এক ব্যবসায়ী শ্রেণী যেমন পরিশ্রমী, তেমনি অর্থশালী কিন্তু এদের চরিত্রবলের খুব অভাব। এইরূপ নীতিহীন স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন মূর্খ নিকৃষ্ট জাতির পক্ষে সাজে। সভ্য ভদ্র মানুষ এরূপভাবে অর্থশালী হতে ঘৃণা বোধ করেন।
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন–”আমার রাত কাটে এবাদতে আর দিন কাটে পরিশ্রমে”। তুর্কী সম্রাট সেলিম সারাদিন কাজ করতেন। রাত্রিতে অল্পই নিদ্রা যেতেন। সারারাত্রি বসে বসে তিনি পড়তেন। জীবনে কাজ ছাড়া অন্য কিছুতে তার আনন্দ ছিল না। নারীসঙ্গ তিনি পছন্দ করতেন না।