অপক্ব অনুন্নত ও অবোধ মন নিয়ে বহু উপাসনা করলেও বিশেষ লাভ হয় না। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, জ্ঞানী ব্যক্তির এক মুহূর্তের উপাসনা মূখের চল্লিশ বৎসরের উপাসনার সমান! তুমি যে অবস্থায় থাক না যে কাজই কর না, তোমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এই-ই তোমার বিধান। পয়সার লোভে যুবক বয়সেই পড়া শেষ করে এখন আরাম। ভোগ করছ? এটা মানুষের জীবন নয়, কাজের চাপে বই-পুস্তক ধরবার মোটে অবসর হয়, এও মানুষের কথা নয়। জ্ঞানকে বাদ দিয়ে উপাসনাকে যে বেশি আঁকড়ে ধরে, সে অপদার্থ। তার ধর্ম-বিশ্বাসের কোনো মূল্য নাই।
কারো কারো ধারণা, কোরান (শঃ) ছাড়া কোনোও পুস্তকে জ্ঞান নাই। এ অতি বড় মূর্খ মানুষের কথা। শিশু কোরানের (শঃ) অর্থ গ্রহণ করতে পারে? কোরান (শঃ) বুঝতে হলে, গীতার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে আমাদের মনটিকে বহু জ্ঞানভাণ্ডারে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে। জ্ঞান চিন্তার দ্বারা আত্মার দৃষ্টি খুলে দাও, সে সমস্ত প্রকৃতির ভিতর দিয়ে আল্লাহকে উপাসনা তুল্য হবে! মুখের সম্মুখে কোরান (শঃ) খুলে রাখ, সে সহস্রবার পাঠ করুক,–ধর্ম পথের কিছুমাত্র সন্ধান সে পাবে না। তার আত্মতৃপ্তির কোনো মূল্য নাই, জাতির যখন অধঃপতন হয়, তখনই সে এমন সঙ্কীর্ণ পন্থায় নিজের জীবনকে সার্থক করতে চায়; সে বাদুড়ের মতো দীপালোক হতে চোখ বুজে বসে থাকে। মানুষকে সব দিক চাইতে হবে, তাকে অনন্ত বড় হতে হবে, তাকে অনন্ত পথে চলতে হবে, তাকে খুব কথা ভাবতে হবে, সে তো সহজ জীব নয়। জাতির পতন হলে, যে গর্বে আপনাতে আপনি ডুবে থাকে, তার সম্বল হয় শুধু ঘৃণা ও অহঙ্কার। যাবৎ কোনো মহাপুরুষ তাকে নতুন করে পথ না দেখিয়ে দেন, তাবৎ সে আঁধারেই পড়ে থাকে। জ্ঞানসাধনা ব্যতীত জাতির দেহে শক্তির সৃষ্টি হয় না, সে তার ধর্ম ও মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে।
ইংরেজ কোথায় না গিয়েছে? বরফের দেশে, দুর্গম গিরিশিরে, আকাশে, মরুভূমে, সমুদ্রর তলে–কোথাও তার যেতে বাকি নাই? সে ভীল, কোল সাওতালী ভাষা হতে পৃথিবীর সমস্ত ভাষার চর্চা করেছে। সে কত পরিশ্রম করে। মুহূর্তকালও তো তার আলস্যে কাটে নাই। তার এই সাধনা ব্যর্থ হয় নাই।
নিজেকে এবং জাতিকে বড় করতে হলে তোমার সমস্ত শক্তির পূর্ণ ব্যবহার চাই। তোমার নিজের বড় হবার উপরেই জাতির বড় হওয়া নির্ভর করে। তুমি ছাড়া জাতি স্বতন্ত্র নয়। জাগরণের অর্থ তোমাদের সকলের জাগরণ। জাতিকে আহবান করা।
অনবরত কাজ করতে করতে মানুষ নিষ্ঠুর প্রাণহীন হয়ে পড়ে। তা যেন স্মরণ থাকে। নিষ্ঠুর প্রাণহীন হয়ে বড় হওয়ার কোনো লাভ নাই।
নিজের জন্য এবং মানুষের জন্য তোমাকে কাজ করতে হবে। নিজের সুখটুকু আদায় করে নিতে পারছ বলে, তোমার তৃপ্ত হবার কোনো কারণ নাই। এই দুঃখ-শাভরা দেশের অনন্ত দুঃখী মানুষের কথা না ভেবে, যে আপনার পূর্ণতায় প্রাণহীন হয়ে বসে থাকে, তাকে আর কী বলবো! সে যদি উপাসনা করে, তা দেখে আমার মন যেন সুখী হয় না।
এ জগতে কতকগুলি লোক আছেন, যাদের কাছে বসে থাকা নিতান্তই অসম্ভব বলে। মনে হয়। তারা ভাবেন, জীবন আমাদের ক্ষুদ্র–কাজ অসীম। সারা জীবন ভরে কাজ করলে যা আমাদের করবার ছিল, শেষ হবে না। আলস্য করবার সময় নাই। মুহূর্তগুলি তাঁদের কাছে অমূল্য জিনিস, জীবনের সুখই হল তাদের সাধনা ও পরিশ্রমে।
লিউনার্ড ডি ভিনসী (Leonardo De Vince) এক সঙ্গে হাজার গণ্ডা কাজ করতেন, তাতে তার কোনো ক্লান্তি হতো না। সারা জসুয়া রেনল্ডকে এক সময় বন্ধুরা গ্রামে ধরে নিয়ে যান। সেখান হতে ফিরে এসে পুনরায় কাজে হাত দিয়ে তিনি যেন পূর্ণ জীবন লাভ করেন।
পেসিন (Poussin) যতই বুড়ো হচ্ছিলেন; ততই তিনি সাধারণ পূর্ণতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। এত যে কাজ করা, তবু তার তৃপ্তি ছিল না। প্রতিভাবান পরিশ্রম করে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। অনবরত কাজ, অনবরত পরিশ্রম–তবুও তাদের মনে হয় কিছু হচ্ছে না। ভার্জিল এগার বছর ধরে তাঁর ইনিদ কাব্যখানি লেখেন। লেখা শেষে তিনি কিছু হয় নাই ভেবে আগুনে পোড়াতে যাচ্ছিলেন। ভলটেয়ার (Voltaire) কোনো বই লিখেই তৃপ্তি লাভ করেন নি! প্রকৃত কর্মী যারা তারা সব সময়েই নিজেকে খুব দীন মনে করেন নিজেদের দরিদ্র অপরাধী ভেবে কর্মের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দেন। তাদের লক্ষ্য হয়, জয়-সাফল্যের গৌরব পতাকা।
যে জাতি সময়ের মর্যাদা জানে, কাজের মূল্য বুঝে, যারা পরিশ্রম করতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তাদের ভবিষ্যৎ কত উজ্জ্বল! লক্ষ লক্ষ মানুষের আলস্য কত কোটি কোটি টাকা মাটি করে ফেলে দিচ্ছে। সময়ের অপব্যবহার করা, আলস্য করে জীবনকে মাটি করে দেওয়ার অর্থ, জাতির কোটি কোটি টাকা অবহেলা করে নষ্ট করে ফেলা।
যে পরিশ্রম করতে তোমার মনে আনন্দ হয়, তাই করো। তোমাকে প্রত্যহ কিছু কিছু করতে হবে। কিছু কিছু করে কয়েক বছর ধরে বিশেষ কোনো কাজ করলে শেষে কাজের ফল দেখে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
কাজ করলেই যখন বিনিময়ে অর্থ, সম্মান, সুখ ও কল্যাণ লাভ হয়, তবে কেন তা করবে না? আলস্যে জীবনকে নিরর্থক করে না দিয়ে, সময় ও সুযোগ থাকতে কিছুকাল পরিশ্রম করে নাও। কে এমন হতভাগ্য আছে, যে জীবনের উন্নতি চায় না? পরমুখাপেক্ষী, অলস ও অভাবগ্রস্ত ভদ্রলোক হয়ে থাকায় কত লজ্জা। তুমি সমাজের এক স্তর নিচে নেমে যাও, বন্ধুরা তোমার সঙ্গে কথা না বলুক, তোমার কোনো আত্মীয়ের নাম করবারও তোমার দরকার নাই, তুমি পরিশ্রম করে যেমন করে হোক অর্থ উপার্জন কর। তোমার ঘরে যেন ভাত থাকে, দান করার জন্য তোমার হাতে যেন পয়সা থাকে, তোমার পত্নীর কাপড়ের যেন অভাব না হয়, অসাধুতা করে অভাব মোচনের প্রবৃত্তিও যেন তোমাতে না জাগে।