দুদিন পরিশ্রম করেই তুমি রাজা হবে, এ মনে করো না। দুই একদিন বা দুই একমাস কঠিন পরিশ্রম করে ফল লাভ করার আশা করো না। বহুদিন ধরে অল্প অল্প পরিশ্রম করলে বরং ফল লাভ হয় কিন্তু অল্প কিছুদিন কঠিন পরিশ্রম করলেও কোনো লাভ হয় না। কোরান (শঃ) বহুস্থানে সহিষ্ণুতার গুণ লেখা আছে। বড় বড় লোক যেমন পরিশ্রমী তেমনি সহিষ্ণু। মন অবুঝ হয়ে বলছে, কতদিনে এ কাজ হবে? কতকাল আর অপেক্ষা করবো? না, এমন কথা ভেবো না। বছরের পর বছর চলে গিয়েছে, আর সময় নাই, এরূপ মনে না করে। সম্মুখের দিনগুলিকেই যথেষ্ট মনে কর। আজকার এই নূতন দিন, বার বছর পর কত পুরাতন হয়ে যাবে তা কি ভেবে দেখেছ?–আজকাল এই নবীন ঊষা কিছুকাল পরে অতীতের স্বপ্ন বলে মনে হবে। এই সময়েই তোমার যাত্রা শুরু হোক। নিজেকে বিশ্বাস করো, এই তুচ্ছ দিনগুলি তোমাকে কত সম্পদ দান করে তা তুমি পরে দেখে নিও। জীবনের দিনগুলি কি অপব্যবহার করা যায়? এই সাধের মানব জন্ম কি আর পাওয়া যাবে? তুমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক দিন হতে মণি রহ কুড়িয়ে নিতে পার। অর্থ সঞ্চয় করা আর সময়ের সুব্যবহার করা একই কথা।
জীবন সাধনার পথে অনেক দুঃখ-ব্যথা আসতে পারে। কিন্তু সে সব দুঃখ-ব্যথাকে উপহাস করে তুমি সময়ের ব্যবহার করো। কেঁদে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জীবন কাটালে কোনোই লাভ নাই, কেউ ফিরে তাকাবে না। পরীক্ষায় পাস করে চাকরির উমেদারিতে বছরের পর বছর পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছ? এতে প্রতিপন্ন হচ্ছে, তুমি নিতান্তই নির্বোধ। চাকরির উমেদারিতে থাক, আর চাকরি-জীবন অবলম্বন করে–সময়কে অনর্থক উড়িয়ে দেবার অধিকার তোমার কৈ? নিজের জন্য না হোক, পরের জন্য তোমার উদ্যম ও শক্তি ব্যয় কর। জীবনের মূলধনটিকে যত খাটাবে, ততই তোমার নিজের কল্যাণের মুদ্রা লাভ হবে; সে মুদ্রা তুমি নিজেই ব্যবহার কর অথবা পরকে দাও। লোহার বাক্সে টাকা আটকিয়ে রেখে লাভ কী? সেগুলি নিজে খাটাও, না হয় পরকে খাটাতে দাও। পরীক্ষায় পাস করেছ বলেই কি তোমার জীবনের সকল কাজ শেষ হয়েছে? শারীরিক পরিশ্রম করবার ক্ষমতা যদি তোমার বাহুতে না থাকে, জ্ঞানার্জন দ্বারা জীবনের দিনগুলি সার্থক কর। নিরক্ষর দেশবাসীকে তোমার চিন্তায় দীক্ষিত কর, এর চেয়ে বড় কাজ কী আর জীবনে আছে? বুদ্ধির দ্বারা মানুষের মঙ্গল করা মহাজনের কাজ। অর্থ অপেক্ষা জ্ঞানের দানই সমধিক মূল্যবান।
জীবনে কোনো পথ হচ্ছে না–পথ একটা তৈরি করে নাও ফিলিপ সিডনী বলেছেন–জীবনের সকল পথ যদি রুদ্ধ হয়, তবু আমি একটা তৈরি করে নিতে পারি–পুরুষের জন্য মুক্তির পথ আছেই। অবিশ্বাসী, পরমুখাপেক্ষী, বিশ্বাসহীন মানুষের জন্য মুক্তির পথ নাই। বিশ্বাস কর, তুমি ছোট হয়ে থাকবে না, না খেয়ে মরবে না–আল্লাহর নামে সহিষ্ণু হয়ে পরিশ্রম কর, তোমার সম্মুখে মুক্তির পথ খুলে যাবে। সন্দেহ ও। আত্মবিশ্বাসের অভাবে মানুষ মৃত্যু লাভ করে। বিশ্বাসের বলে বাবর শাহ রাজ্য লাভ করেছিলেন, ভিখারী শিবাজী রাজা হয়েছিলেন। মানুষ ইচ্ছা করে ছোট ও দরিদ্র হয়। তার ছোট ও দরিদ্র হবার কোনো কথাই নাই। তার শুধু সহিষ্ণু পরিশ্রম চাই। জয়ের জন্য শুধু আল্লাহর দিকে চেয়ে থেকো না। তোমার বাহুতে শক্তি আছে, তোমার মাথায় যে বুদ্ধি আছে, তার ব্যবহার তুমি কর।
নিজের শক্তিকে অবিশ্বাস করে মানুষের কাছে যে দয়া ভিক্ষা করে, সে অপদার্থ। মানুষের কাছে কেন ভিক্ষা করবে? আল্লাহ তোমার দুখানি শক্তিশালী হাত, দুখানি পা, আর মুখে ভাষা দিয়েছেন,–এই তো যথেষ্ট।
যে কাজে প্রাণ ঢেলে দেওয়া যায় না, তাতে বিশেষ লাভ হয় না। কাজ করতে যদি মনে আনন্দ অনুভব না হয়, তাতেও বিশেষ ফল হয় না। তুর্কী জাতির সম্মুখে ইউরোপের সমস্ত শক্তি বিধ্বস্ত হতো কেমন করে? তুর্কীরা প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করতো! দেশের মমতায় যারা যুদ্ধ করে, আর যারা টাকার জন্য যুদ্ধ করে–এদের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি! পারস্যের সৈন্যকে কী করে মুষ্টিমেয় রোম সৈন্য হারিয়ে দিয়েছিল? রোম প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তাই সে জয়লাভ করেছিল। প্রাণ-মন ঢেলে না দিয়ে অনিচ্ছায় সারারাত্রি পড়, কোনো লাভ হবে না। শরীর কোনো কাজ করে না, কাজ করে মন। পরিশ্রমের সঙ্গে কোনো আশা পোষণ করা মন্দ নয়–আশায় মানুষ পর্বত লঙঘন করে। মানুষ অনেক সময় বলে থাকে, সময় নাই–প্রকৃত কথা তাদের প্রাণ নাই। প্রাণের ইচ্ছা না থাকলে কোনো কাজ সুসিদ্ধ হয় না। যে কাজে প্রাণের যোগ আছে, তা অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সম্পন্ন করা যায়।
জীবনে অর্থ লাভ করবার জন্য নিজেকে বড় করে তোলার জন্য পরিশ্রম কর। কখনও বলো না আমি যা বুঝি তা সম্পূর্ণ। সারা জীবন ভরে জ্ঞানালোচনা করলেও তো বুঝার শেষ হবে না।
জ্ঞানের জন্য যে পরিশ্রম করা যায়, তার মূল্য খুব বেশি। জ্ঞানই জগতের কাজকে সরল, সুখময় ও সহজ করে তোলে। কাষ্ঠের বাক্সগুলি হাতে তৈরি করতে গেলে, একদিনে তো একটাও করা যাবে না এবং তার প্রত্যেক বাক্সের দাম পড়বে এক টাকার কম নয়। জ্ঞানবলে মানুষ ঐরূপ হাজার হাজার বাক্স প্রতি ঘণ্টায় তৈরি করছে।
মাটিতে ধান ফেললে যে ফসল উৎপন্ন হয়, একথা পণ্ডিতেরাই মানুষকে শিখিয়েছে, এ জগতের সকল কাজ জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়। দিনে রাতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম কর–তার মূল্য পাবে ছাই। শারীরিক হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের সঙ্গে যদি তোমার বুদ্ধিবল থাকতো, তা হলে তুমি রাজা হতে পারতে। সংসারের সকল কাজ চলছে, শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তবু বৃষ্টি-বাদলার মাঝে, গভীর রাতে, দুপুর রৌদ্রে সংসারে কাজে হেঁটে বেড়াতে পার, আর তোমার আত্মার মঙ্গলের কোনো চেষ্টা করতে পার না?