যে কুঁড়ে এবং আলসে, তার স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না, তার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে।
শরীরের পরিশ্রম অপেক্ষা মাথার পরিশ্রমের মূল্য বেশি। হাত-পাগুলি মাথার আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। বুদ্ধিহীন মাথার আদেশ পালন করতে যেয়ে হাত-পাগুলির পদে পদে দুঃখ আর বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়।
জগতের শ্রেষ্ঠ ও সভ্য জাতিগুলি মস্তিষ্কের সদ্ব্যবহার করেই বড় হয়েছে। সভ্য জাতির সামনে টিকে থাকতে হলে নিজেদের সম্মান ও জীবনের জন্যে বেশি করে মাথার সদ্ব্যবহার করতে হবে। চারদিকে যে এত বেদনা, এত দুঃখ দেখতে পাচ্ছ, এর একমাত্র কারণ জাতির বুদ্ধির দৈন্যতা।
ব্যাধি, অনাহার এইসব দরিদ্র জাতির মধ্যেই বেশি দেখা যায়। শত শত বছর আমরা আমাদের জীবনের মূল্য বুঝি না, কেন আমরা পথে পড়ে মরবো না? যে পরিশ্রম করে না তার দুঃখ তো হবেই। বিশ্বের পথে যে চারদিকে চেয়ে না চলে, তাকে তো রথের চাকার তলে পড়ে চূর্ণ হতেই হবে।
চুরি-বাটপাড়ি করে, দেশের মানুষকে কৌশলে ফেলে পয়সা অর্জন করা বিশেষ কঠিন নয়; কিন্তু এ ভাবে পয়সা উপায় করে বেঁচে থাকা যদি অন্যায় না হয়, তা হলে অভাবগ্রস্থ লোকদের বিরুদ্ধে কথা বলবার অধিকার তোমার নাই।
জীবনে অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে সুখী ও ভদ্রলোক হতে যেয়ো না; তার চেয়ে মুটে মজুরের মতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জীবনের পবিত্রতা রক্ষা করা বেশি মনুষ্যত্ব।
জীবনকে বড় করে তোলার ক্ষমতা, মানুষকে সুখ দেবার ও সাহায্য করবার ক্ষমতা তোমার মধ্যে আছে। মানুষের সকল সুখের মূল অর্থ। নিজের পরিবার ও দীন-দুঃখীর সেবা করাও অর্থ ছাড়া হয় না। যার বুদ্ধি আছে, যে পরিশ্রম করতে পারে, তার দুঃখ নাই। জীবনে সে নিজে সুখ সংগ্রহ করে নিতে পারবে, পরকেও সে সুখ দেবে। যে অপদার্থ সেই দরিদ্র হয়। দরিদ্র হয়ে থাকা জীবনের পক্ষে এক অপমান। যে সমাজে সামাজিক মর্যাদা ঠিক রাখবার জন্য দরিদ্র হয়ে থাকতে হয়, সে সমাজ তুমি ত্যাগ কর। দেশের মায়ায় গ্রামের মায়ায় জীবনের দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কী? যেখানকার মানুষ তোমার সাদা কাপড়, তোমার চটক দেখে তোমায় সম্মান করে; তোমার অভাব ও ঋণের জন্য তোমাকে ঘৃণা করে, সেস্থান ছেড়ে যেখানে পয়সা আছে সেখানে চলে যাও-নারী-পুরুষ ছেলে-মেয়ে কঠিন পরিশ্রম কর–দুঃখ থাকবে না। অলস পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে যারা প্রতিজ্ঞা করেছে, তারাই এ জগতে দুঃখী হয়ে থাকে।
মানুষের নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস নাই, তাই সে এত ভীরু। ভিখারির মতো সে মানুষের দয়ার পানে চেয়ে থাকে। কে তোমাকে এ জগতে পাঠিয়েছে, মানুষ তোমার খোদা নয়। যে তোমাকে এ জগতে পাঠিয়েছে, সেই তোমার আহার ঠিক করে রেখেছে। তোমাকেও পরিশ্রম করতে হবে, খুঁজে নিতে হবে, ঘরের মধ্যে বসে কাঁদলে চলবে না। খোদাতালা সব সময়ে তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার কথা ভেবে তারই উপর নির্ভর করে তুমি সাগরে ঝাঁপ দাও। সাবধান, অন্যায়কে আশ্রয় করে কখনো খোদার নাম নিও না। অন্যায়ের সঙ্গে যার জীবন জড়িত হয়ে আছে, তার খোদাকে ডাকবার অধিকার নাই। মানুষ যেদিন অন্যায়কে অবলম্বন করেছে, সেদিন সে মিথ্যাকে আশ্রয় করেছে, সেদিন সে আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতা আরম্ভ করেছে। আল্লাহ্ দয়ালু এ কথা ভেবে তোমার পাপ করার কোনো অধিকার নাই। অবিবাহিত চরিত্রহীন ব্যক্তিকে বরং ক্ষমা করা যায়, কিন্তু বিবাহিত মিথ্যাবাদী, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী, নিষ্ঠুর স্বার্থপর মানুষকে আমরা কখনও ক্ষমা করতে প্রস্তুত নই। যে অনাথিনী বিধবার সম্পত্তি অপহরণ করে, যে মানুষের সঙ্গে দাম্ভিক ব্যবহার করে, যে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করে না, যে নিন্দুক, যে দুর্বল নারী জাতির উপর অত্যাচার করে,–সে খোদার শত্রু।
মানুষ যে পথে গিয়েছে, সে পথেই যে তোমাকে চলতে হবে তা নয়। যে পথে চলে হাজার মানুষের দুঃখের মীমাংসা হয় নি, দেখাদেখি তুমিও কেন সে পথে চলো? তোমাকে নতুন পথ খুঁজে নিতে হবে–যে পথে কেউ যায় না, সেই পথেই তুমি চল। তোমার সত্য জীবনের সঙ্গে তুমি সন্ধি স্থাপন কর–তুমিই আদর্শ ভদ্রলোক, আমি তোমাকে সম্মান করবো। এ জগতে কে তোমাকে ছোট বলে ঘৃণা করে? করুক না–তুমি যেন নিজেকে ঘৃণা না কর। তোমার মনুষ্যত্ব, তোমার বিবেক যেন তোমাকে ঘৃণা করার অবসর না পায়। পরাধীন জাতির ভদ্রলোক কে তা ঠিক করে বলতে পারি নি। তোমাকে ছোট বলে কোনো অভাগা ঘৃণা করবে, তা আমি বুঝি না। ছোট বলে কেউ যদি তোমাকে হীন চোখে দেখে, দেখুক আপত্তি নাই–যেন মিথ্যাবাদী দুবৃত্ত না বলে।
মিথ্যা সম্মানের জন্য কি পল্লীর দরিদ্র ঘরের সতী কুলবধূ চরিত্রহীনা বড়লোকদের বিলাসিনী পতিতা বন্ধুদের স্বর্ণালঙ্কার ও বহুমূল্য পোশাক-পরিচ্ছেদ পরতে চায়? এ জগতে গায়ের জোরে অনেকেই ভদ্রলোক হতে পারে, গায়ের জোরে তোমার ভদ্রলোক হয়ে দরকার নাই।
জীবনের কাজ করতে হলে বড় সহিষ্ণুতা চাই, খোদার উপর বিশ্বাস করে সহিষ্ণু হয়ে পরিশ্রম করো, দুঃখের মেঘ তোমার মাথার উপর হতে সরে যাবে। আমি এ কথা পুনঃ পুনঃ বলছি, যে পাপী, মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড, সে যেন খোদার উপর নির্ভর করে খোদার মহিমা ও দয়ার অপমান না করে। যে মিথ্যাবাদী মানুষকে ব্যথা দেয়, যে ভণ্ডমানব সমাজের দুঃখ বর্ধন করে কী বলে খোদা তাকে ভালবাসেন? কুকুরের মতো পরিত্যক্ত হাড় খেয়ে সে এ জগতে বেঁচে আছে।