টাকা-পয়সার অপব্যবহার করলে লোকে অমিতব্যয়ী লক্ষ্মীছাড়া বলে, সময়ের অপব্যবহার যে করে সে অমিতব্যয়ী। সময়ের সদ্ব্যবহার কর–সময়ের আর এক নাম সম্পদ, লেখাপড়া শিখে চাকুরি করা ছাড়া কি জীবনের আর কোনো ব্যবহার নাই। কামারের লোহার কাজ, টুপি তৈরি, পুস্তক বাঁধাই, কল-কারখানার কাজ, কাপড় তৈরি ও কাঠের কাজ, খেলনা তৈরি, লণ্ঠন ও ছড়ি তৈরি প্রভৃতি বহু শিল্প তুমি শিখতে পার।
শিল্প জাতির গৌরব–শিল্প দেশকে সৌন্দর্য ও সম্পদে পূর্ণ করে ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলি তার প্রমাণ। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ; এখানে মাটি হতে সোনা ফলান যায়। মাটির ফসল হতেই জীবনের অভাব পূরণ হল, তা হলে মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সমস্যার ভার হতে তুমি মুক্ত হলে। বিদেশী বিলাদ্রব্য কিনে, নিত্য নূতন অভাব সৃষ্টি করে, জীবনের দৈন্য না বাড়িয়ে নির্বিবাদে পল্লীর নির্জন প্রান্তে বসে জীবনের শত রহস্যের সন্ধানে জীবনকে ব্যাপৃত রাখ, বিশ্বের চিন্তাশীল পণ্ডিতমণ্ডলীর লেখা পাঠ করে নূতন নূতন কলকারখানা উদ্ভাবনে মনোনিবেশ কর,–বিজ্ঞান আলোচনা কর, তোমার চিন্তা তোমার জ্ঞান জাতিকে দান কর।
তোমার চারিদিকে যে সমস্ত জাতি বড় আসনে উপবিষ্ট রয়েছে, এদের বড় হবার মূলে কত পণ্ডিতের চিন্তা বিদ্যমান। কয়েকটি টাকার জন্যে ভিক্ষুক জীবনের অভিশাপ নিয়ে তোমার আত্মাকে বিনষ্ট করে ফেলো না। তোমার ভিতরে কত বড় শক্তি সম্ভাবনা ঘুমিয়ে রয়েছে তা হয়তো তুমি জান না! মানুষের আত্মা ফেলে দেবার জিনিস নয়। জ্ঞান-চর্চার দ্বারা তোমার আত্মার ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোল। মানুষ যে কত বড়, সে কেমন বড় ও সম্মানী হতে পারে, তা হয়তো সে জানে না, তাই সে সম্মানের জন্য মানুষের দুয়ারে যায়, পথে আবর্জনার দামে তার অমূল্য রত্ন বিক্রয় করে।–পরিতাপ!
মানুষের বুকের ভিতরে কী শক্তি লুকিয়ে আছে, তাকে জাগ্রত কর, সে অসাধ্য সাধন করবে। তাকে বলে দাও, সে অফুরন্ত শক্তির মালিক। কেন সে ছোট হয়ে আছে?–নিজের সিংহাসন সামনে রেখে কেন সে ভয়ে ভয়ে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তুমি ছোট, তুমি হীন? পতিত, অবজ্ঞাত, হীন, ছোট মানুষের কানের কাছে আজ আমাদিগকে শক্তির গান গাইতে হবে। মানুষ পাপ ও মূর্খতাকে ঘৃণা করতে শিখুক, সে জ্ঞান সাধনার দ্বারা আত্মচেষ্টায় মানুষের সম্মান পূজা লাভ করুক। জলে বৃষ্টিতে কি গা ভেজে না? পিচ্ছিল পথে কি মানুষ হাঁটে না? পড়ে যেয়ে কি পথের মাঝে বসে থাকতে হবে? আল্লাহর সৃষ্টি-রহস্য বুঝতে পারি নি, দুঃখ-সুখ সবাই তার স্নেহের দান; কিন্তু দুঃখে পড়েছি বলে কি আমি দুঃখকে জয় করতে চেষ্টা করব না? পাপ অন্যায় করেছি, অজ্ঞান অন্ধকারে আত্মা অচেতন হয়ে আছে, সে অজ্ঞান–সে আঁধার কি ঘুচাতে হবে না?
ভদ্রলোক রাজা, জমিদার বড় মানুষের ছেলে জ্ঞানে অর্থে পুণ্যে ধর্মে বড় হবে, আর যারা ছোট, তারা চিরকালই ছোট হয়ে থাকবে, এ তোমরা কেউ বিশ্বাস করো না। যে তাঁতী, যে জেলে, যে কামার, যে রাজমিস্ত্রি সেও ভদ্রলোক হতে পারে। চাই তার জ্ঞান, চরিত্র-শক্তি বিনয় ও সত্যপ্রিয়তা। বিনয়ের অর্থ অত্যাচারী অহঙ্কারী ব্যক্তির পদধূলি মাথায় নেওয়া নয়। অত্যাধিক বিনয় ও ভক্তি নম্রতার মানব জীবন অনেকখানি ব্যর্থ হয়ে যায়! অসন্তোষ ও বিদ্রোহ এ দু’টিও চাই।
তুমি দরিদ্র নও, তোমার ভিতরের শক্তিকে তুমি জাগিয়ে তোল। জীবনে যে কোনো অবস্থায় যে কোনো সময় তুমি নিজেকে বড় করে তুলতে পার। তোমাকে কোথায়ও যেতে হবে না, তোমার ছোটও হতে হবে না, এই বয়সেই তুমি জগতের পণ্ডিতমণ্ডলীর চিন্তার সঙ্গে যোগ স্থাপন কর, জীবন ব্যর্থ হবে না।
সামান্য কৃষক হয়ে জীবনকে অবনমিত করে ফেলেছ, এ মনে করো না। আলোক রহস্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, শরীরতত্ত্ব, ইতিহাস, বিবিধ ধর্মশাস্ত্র আলোচনা করে কি তুমি তোমার জীবনকে ধন্য করতে পার না? স্কুল কলেজে না গেলেই কি জীবন মাটি হয়ে গেল? জান না কোনো বাধাই জীবনের গতিকে রুদ্ধ করে রাখতে পারে না। চিন্তা ও সাধনা দ্বারা সকল বিঘ্নের মীমাংসা হয়ে যাবে। যে বিষয় ভালো লাগে, জীবন ভরে তারই আলোচনা করো, তোমার সমাজকে তুমি মৃত্যুর পূর্বে তোমার কাজে ঋণী করে রেখে যেতে পারবে। উপাধি না পাও কোনো ক্ষতি নাই! তোমার গুণের আদর না হয়, তাতেও বিশেষ কিছু মনে করবার দরকার নাই। জ্ঞান আলোচনার যন্ত্রপাতি, বড় বড় অধ্যাপক ও অট্টালিকা দরকার নাই। অধ্যাপকের আড়ম্বর আর যন্ত্রপাতিতে মানুষ জ্ঞানের পথকে বরং অসরল, অসহজ করে তুলেছে। জ্ঞানের পথ সব সময়েই আনন্দ ভরা ও সহজ। অর্থলাভ শিক্ষকদের শাসন, গুরুজনের অসহিষ্ণুতা আর সাধারণ মানুষের ধিক্কার-ভয় জ্ঞানের আনন্দকে নষ্ট করে ফেলেছে। এক একটা বিষয় বুঝতে দার্শনিক পণ্ডিতদের কতদিন কতমাস কেটে গিয়েছে তা আমাকে একদিনেই ঠিক করে নিতে হবে! বিদ্রোহী অবুঝ মনকে পিটিয়ে বুঝতে ও জানতে হবে, এতে কি প্রকৃত জ্ঞান লাভ হয়? এই ভাবের জ্ঞান সাধনায় কি আনন্দ আছে?
যে বিষয়ে আলোচনা করতে মনে খুব আনন্দ জন্মে, তুমি, সেই বিষয়েরই আলোচনা কর; জীবনে তুমি কীর্তি অর্জন করতে পারবে।
আলস্য করে, শুধু খেয়ে-পরে, শুধু পৃথিবীর কলহ-দ্বন্দ্ব নিয়ে তুমি তোমার জীবনকে নিরর্থক করে দিও না–এ আমার অনুরোধ।