জীবনের অপমান হয় দুটি জিনিসে–প্রথমত অজ্ঞতায়, দ্বিতীয়ত পর নির্ভরশীলতায়।
অজ্ঞতার ন্যায় মহাশত্রু মানব জীবনে আর নাই। জীবনে যে অবস্থাতে থাক না, তোমাকে জ্ঞানের সঙ্গে যোগ রাখতে হবে। জ্ঞানের চরম সার্থকতা মানুষকে ভালো মন্দ বলে দেওয়া,–তার আত্মার দৃষ্টি খুলে দেওয়া, তার জীবনের কলঙ্ক-কালিমাগুলি ধুয়ে ফেলা। অর্থ আছে বলে বা কাজের অজুহাতে যাদের জ্ঞানের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকে না, অজ্ঞাতসারে নিজদেরকে পতিত করে। দাম্ভিকতা ও অর্থে প্রভাব তাদের মনুষ্যত্বকে খর্ব করে দেয়।
দরিদ্রতম-দরিদ্র অপেক্ষা যে হতভাগ্যের অলস কর্মহীন জীবন অন্যের উপর নির্ভর করে, তার অবস্থা অধিকতর শোচনীয়। এতে মনুষ্যত্বকে একেবারেই চূর্ণ করে ফেলা হয়। জীবনে সকলের চেয়ে উচ্চ লক্ষ্য হবে, তোমাকে জীবনে যেন পরের দয়ার উপর নির্ভর না করতে হয়, কোনো সময়ে যেন মানুষের সামনে তোমার মন সঙ্কুচিত না হয়ে ওঠে। তোমার মাঝে যে বিবেক-বুদ্ধি আছে, তাকেই যেন তোমাকে ভয় করতে হয়।
কোনো ছোট কাজ করেও যদি জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যায় তাও ভালো। কর্মহীন দীন জীবন কত দুঃখের, তার মুখোনি কত করুণ। বৃথা তার জীবন, বৃথা তার মানব সমাজে বাস। মানব জীবনের এই দারুণ অপমান হতে নিজেদের উদ্ধার করতে হবে। নারী-পুরুষ উভয়েরই যেন জীবনের চরম লক্ষ্য হয় এই। যে ন্যায় ও সত্যের অপমান করে, মানুষকে ভয় করে, তার উপাসনার কোনো মূল্য হয় না। যে মানুষের কাছে নিজের আত্মাকে বিক্রয় করেছে, তার আত্মায় খোদার আসন হবে না। আত্মার উপর আল্লাহ ও ন্যায়-সত্য ছাড়া আর কারো প্রভাব যেন না পড়তে পারে।
যে কোনো হীন ব্যবসা করা ভালো তবু বাইরে চাকচিক্য বজায় রাখবার জন্য অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করা ঠিক নয়। তোমার পত্নীর পরনে ভাল শাড়ি, তার গায়ে সোনার গহনা দেখে নর-নারী প্রশংসাপূর্ণ বিনীত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকবে তোমার ভালো ঘোড়াটি, তোমার দাস-দাসী ও খানসামা-পেয়াদা দেখে হয়তো তোমার মন অহঙ্কারে ভরে উঠবে–তোমার অসত্য জীবনের, তোমার দীন হৃদয়ের খবর তোমার পত্নীর কাছে হয়তো ঢাকা আছে; মানুষও তা জানে না। কিন্তু তুমি তো জান? তোমার মনুষ্যত্বের কাছে তো এ কেলেঙ্কারী অবিদিত নাই। মানুষের এই প্রশংসার দৃষ্টি ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান কর, তোমার এই অনুভূতি একেবারে চূর্ণ করে দাও।
আত্মাকে অবনমিত করে কে কুকুরের মতো দেহটিকে বাঁচাতে চায়, আত্মাকে পতিত করে ধর্ম জীবনকে ঠিক রাখা যায় না–এ যদি মানুষ না বোঝে, তবে সে কী প্রকার মানুষ? কোন ধর্মের লোক সে? কোন্ মহাপুরুষের দীক্ষা সে লাভ করেছে, অর্থ ও রুটির জন্য দীন-ভিক্ষুক হয়ে মানুষকে সালাম করতে হবে, এর চেয়ে বড় লজ্জা, বড় অপমান জীবনে আর কী আছে?
আমি মানুষ, এ জগতে আমার বাঁচার অধিকার আছে। তোমার ইচ্ছা হয়, আমাকে সম্মান করনা হয় করো না, ও আমি ভিক্ষা করে নিতে ইচ্ছুক নই। আমি কারো মনে অন্যায় করে আঘাত দিতে চাই নে। আমি দীনাতিদীন, তাই বলে মানুষের পদলেহন করা আমার কাজ নয়–যা সত্য বলে বুঝি, তাই আমি করবো–মানুষের সত্য গ্রহণের জন্য আমার আত্মা উন্মুখ। আমি যা বুঝি তাই অভ্রান্ত সত্য–এ কথা আমি বলি না। আত্মা আমার স্নেহ-করুণায় ভরা, আমি প্রতিবেশীর ক্ষতি করি না। আমার নয়নে জল আসে, আমার কথা ও কাজের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্য নাই। আমি মিথ্যাবাদী নই, আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে কথা বলি, পাছে আমার কথায় কোনো অশুভ হয় এই ভয়ে; দেশকে ভালবাসি বলে সময়াভাবে নিরন্ন প্রতিবেশী ও দীন-দরিদ্রের কথা আমি ভুলি না, জাতির স্বাধীনতা চাই বলে দুর্বলকে আমি রূঢ় কথা বলি না; আমার বেশি বুদ্ধি আছে বলে আমি আমার বোকা প্রতিবেশীর সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করি নাই, আমি কখনও মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করি না, ঋণ পরিশোধ করতে আমি ইতস্তত করি না–আমি স্বাধীনচিত্ত কৃষক, আমি নিজের হাতে লাঙ্গল চষি, জগতের পণ্ডিতমণ্ডলীর সঙ্গে আমার যোগ আছে; জিজ্ঞাসা করি কে আমাকে ছোট বলে?
ডেপুটি সাহেব, দারোগা বাবু, উকিল বাবু আমাকে সম্মান করে না। তাতে আমার . কিছু আসে যায় না; পল্লীর অজ্ঞাত–দুঃখিনী বিধবা আমার নাম করে চোখের জল ফেলে, সর্বহারা নিঃসহায় দরিদ্র বুড়ো ডেকে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করে, তরুণ যুবকটি আমার স্নেহ নেবার জন্যে আমার কাছে আসে–ঐ আমার ঢের। আমি কারো কাছে কোনো সম্মান চাই না, কোনো বড় আত্মীয় আমার নাই, চেয়ারে আমি বসি না, যাদের পেট ভরা ভাত আছে, তাদেরকে খাইয়ে আমি নাম ক্রয় করি না–আমার পত্নীর গায়ে বহু গহনা নাই, আমার ছেলেরা চাকরের সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলে না।
কাজ করলে অসম্মান হয়?–অসম্মান হয় মূর্খ হয়ে থাকায়, পাপ জীবনে, আত্মার সঙ্কীর্ণতায়। জীবনকে কলঙ্কিত করে লোকের সঙ্গে উঁচু মুখ করে কথা বলতে কি লজ্জা হয় না–তঙ্করকে আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে তোমার মনে ঘৃণাবোধ হয় না?
কাজ করতে কোনো লজ্জা নাই। পবিত্র সন্তুষ্ট মন নিয়ে পরিশ্রম কর, তোমার জীবনে সোনা ফলবে। হৃদয়ে আশা পোষণ করে কাজ করাতে কত আনন্দ পাওয়া যায়। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ কেমন করে কাজ করে। যুবক বয়সে নিষ্কর্ম জীবন যাপন করা খুবই বিপজ্জনক। মেয়েদের পক্ষে আরও বিপজ্জনক। কাজ নাই কর্ম নাই–অনবরত শুয়ে। বসে থাকলে মাথায় হাজার তরল চিন্তা আসে। জীবনে তরল চিন্তার ধাক্কা সামলান বড় কঠিন। যার মাথায় একবার তরল চিন্তা ঢুকেছে, তার আর রক্ষা নাই–অধঃপতন হবেই।