মহাপুরুষ ডাক্তার বার্নাডো সারাজীবন গৃহহারা পথের বালক-বালিকাকে কুড়িয়ে বেড়িয়েছেন। মানুষ যাদের কথা ভাবে নি; বার্নাডো তাদের জন্য অশ্রু ফেলেছেন। এ জগতে এক একটা মানুষ কত মহৎ, কত বিরাট প্রাণ নিয়ে আসেন। তাদের নয়নে শুধু অশ্রু ঝরে, হৃদয়ে অনন্ত প্রেম বয়-মহত্ত্ব ও পুণ্যের প্রতিচ্ছবি,–তাঁরা যে পথ দিয়ে যান, সে পথের ধূলিকণাগুলিও পবিত্র হয়ে উঠে। তারা নিজের জন্য বেঁচে থাকেন না।
সব সময়ই কি ঐশ্বর্য ও সুন্দরী পত্নীর জন্য লালায়িত থাকবে? ত্যাগ ও প্রাণের পূজা করতে কি তোমরা শিখবে না? দরিদ্রের করুণ মুখ, নিঃসহায় নর-নারীর দীর্ঘশ্বাসকে সম্মান জানাতে তোমাদের মন কবে আনন্দ বোধ করবে? উচ্চ অট্টালিকার আলোক-উজ্জ্বল কক্ষ, সাহানা–মল্লার মুকরিত ধনীর মর্মর সৌধ অপেক্ষা দরিদ্রের পর্ণকুটিরও সন্ধ্যার অন্ধকার সমাচ্ছন্ন বকুলগাছের পাতা-ভরা উঠানটিকে কবে বেশি শ্রদ্ধা করতে শিখবে? দেবতার জন্য সবাই পথ সাজিয়ে রেখেছে, পাপীর জন্য কবে তুমি ক্ষমা আর স্নেহ ছড়িয়ে দেবে? মধুর কথা শুনে, সদ্ব্যবহার পেয়ে আমার মন পুলকে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে–নিষ্ঠুর কথা আর মানুষের দুর্ব্যবহার পেয়েও কবে তুমি নির্বিকার ও শান্ত হয়ে থাকতে শিখবে?
২. কাজ
জীবনে মানুষকে কাজ করতে হবে, কারণ কাজের মাধ্যমেই মানব জীবনের সুখ ও কল্যাণ নিহিত। মানব সমাজের সুখ ও কল্যাণ বর্ধন ছাড়া জীবনে আর কিসে আনন্দ পাওয়া যায়? মানব সমাজের কথা বাদ দিয়ে যদি নিজের সুখের কথাও চিন্তা করা যায়, তা হলেও আমাদেরকে কাজ করতেই হবে। মাথার ঘাম পায়ে না ফেলে জগতে কোনো সম্পদ লাভ করা যায় না।
সাধনা ও পরিশ্রমের সঙ্গে যদি জ্ঞানের যোগ থাকে, তবে লাভ হয় খুব বেশি। মূর্খ শত পরিশ্রম করে যা না করতে পারে, জ্ঞানী অল্প পরিশ্রম করেই তা করতে পারেন। বড় বড় কল কারখানা রেলওয়ে, স্টীমার, তড়িতের অপূর্ব শক্তিরহস্য জ্ঞানীর মাথা হতেই বের হয়েছে।
আলস্য করেই জাতি ধ্বংসের পথ তৈরি করে। মানুষকে দোষ দিয়ে কী লাভ? কেউ আমাদেরকে ছোট করে না, নিজের পতনের পথ আমরা নিজেই তৈরি করে নেই।
এ জগতে শুধু মুটে-মজুরেরাই পরিশ্রম করবে–এ হতে পারে না। দৈনিক আহার সংস্থানের জন্য তাদেরকে পরিশ্রম করা দরকার হয় বটে; কিন্তু বড় যারা তাদেরকে পরিশ্রম করতে হবে। পয়সা-কড়ির অভাব নাই, নিজের অর্জিত ধন-সম্পত্তিতে দিন বেশ চলে যাচ্ছে, সুতরাং কোনো কাজ করবার দরকার নাই,–এমন কথা বলবার তোমার কোনো অধিকার নাই। এই যে ধন-সম্পত্তি, যা তুমি ভোগ করছ; এগুলি সগ্রহ করতে তোমার পিতাকে কতখানি পরিশ্রম করতে হয়েছিল, তা কী তুমি একটুও ভাব না? রাজা হও, নবাব হও, নিজের জন্য না হোক তোমার পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য তোমাকে কাজ করতে হবে। কাজ না করে, এই দীর্ঘ জীবনটা কী করে কাটিয়ে দেওয়া যায়? আলাপ, রহস্য, হাসিঠাট্টা, খেলাধূলায় অনুরক্ত ব্যক্তিরা অফুরন্ত আনন্দ লাভ করতে পারে, কিন্তু কেমন করে এই সব লক্ষ্যহীন তরুলতার মধ্যে তোমার মহিমান্বিত জীবনকে ডুবিয়ে রাখতে পার? তোমার কাজ আছে, বড় লোকদের সঙ্গে দেখা করে, হেসে, গান করে তুমি তোমার জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পার না!
এ জগতে যারা বড় হয়েছেন, নাম করে মানুষ ধন্য হয়–যারা জগৎ সংসারকে বহু কল্যাণ সম্পদ দিয়ে গিয়েছেন, তারা জীবনে অনবরত কাজ করেছেন। অলসের উপাসনার কোনো মূল্য নাই। কাজের মধ্যে কী এবাদত নাই? শুধু আল্লা আল্লা’ করে খোদাকে তৃপ্ত করা যায় না–এ তুমি বিশ্বাস কর।
দুঃখী নর-নারীর জন্য পরিশ্রম করা কী এবাদত নয়? বিপন্ন মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করা কী এবাদত নয়? আল্লাহর জন্য পয়সা উপায় কী এবাদত নয়?
জগতে যে সমস্ত সুবিধা আমরা ভোগ করছি, এর মূলে কত মানুষের সাধনা বর্তমান–হয়তো কেউ তাদের নামও জানে না। যুদ্ধক্ষেত্রে যে সমস্ত মানুষ প্রাণ দিয়ে জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করে, তাদের কয় জনের নাম মানুষের মনে আছে?
আলস্যে মানুষের এবং জাতির সর্বনাশ হয়, মানুষের সুখ ও জাতির কল্যাণের মূলে কুঠারাঘাত হয়। কতকগুলি মানুষ আয়াস-আরামে জীবন কাটাতে পারে; কিন্তু এই আয়াস-আরামের উপকরণ যোগাবার জন্যে বহু মানুষ প্রাণপণ পরিশ্রম করছে। জাতির স্বাধীনতা ও শক্তি বাচিয়ে রাখবার জন্যে সভ্য জাতির মধ্যে কী বিপুল বিরাট সাধনা চলতে থাকে! ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যারা মোটেও চিন্তা করে না, তাদের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। যারা অভাগা, মূর্খ, তারা এ সমস্ত কথার কিছুই বোঝে না। তাই তারা হাসি-উল্লাসে জীবন কাটিয়ে দেয়। নিজেদের উদ্যত সাধনা ব্যতীত খোদা কখনও মানুষকে বড় করে না। মানুষের অভাব বেদনা মানুষকেই মীমাংসা করতে হবে!
যাদের মধ্যে চরিত্রবলের খুব অভাব, যারা পরের ধন অপহরণ করে বাঁচতে চেষ্টা করে, তাদের পরিশ্রম করবার কোনো দরকার নাই। মানুষকে সত্যপথে জীবন-যাত্রা নির্বাহ করতে হলে, তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর কঠিন সংযম চাই। মান-অপমানের জ্ঞান ভুলে যেতে হবে; ভেবে নিতে হবে চুরি করলে, পরমুখাপেক্ষী হয়ে অলস জীবনযাপন করলে জীবনের অপমান হয়। সত্যপথে থেকে যে কোনো কাজ কর তোমার দুঃখের মীমাংসা হবে। মানুষ তোমাকে ছোট কাজ করতে দেখে নাক সিটকাতে পারে, কিন্তু যে নাক সিটকায়, দুর্দিনে তার কাছে একটা পয়সা চেয়ো, দেখবে সে কেমন করে তোমার কাছ থেকে সড়ে পড়ে। উপরে খোদা আর নিচে তুমি, মানুষের চেয়ে খোদার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ বেশি, কত মানুষ এ জগতে এসেছিল–কোথায় তারা? খোদা চিরকাল আছেন–তোমার। জীবনের হিসাব তারই সঙ্গে হবে। যে দাম্ভিক ও অহঙ্কারী, সে তোমায় ঘৃণা করে মানুষের চোখ মুখে উল্লাসের হিল্লোল তুলেছে–সে কয়দিন বাচবে? মানুষের উপহাসকে ভয় করে অন্যায় করে জীবনকে বড় করে তুলবার কোনো দরকার নাই, মানুষ তোমাকে সম্মান করে বড় আসন দিক আর না দিক, কোনো ক্ষতি নাই–দাম্ভিক ধনবান মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ তোমার খুব অল্প। এরূপ মানুষের কাছ থেকে তুমি ফিরে এস। যা উচিত সেই পথ অনুসরণ করলে শত রকমে জীবনকে বড় করে তোলা যায়। ফর্সা কাপড় পরে ভদ্রলোকের কাছে সম্মান বজায় রাখবার জন্য নিজের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে ফেলো না। সে তোমাকে অপমান করে তৃপ্তি লাভ করেছে, বিশ্বাস কর তার চেয়ে সুখের জীবন তোমার–তুমি অন্যায় করো না, তোমার জীবনে কোনো পাপ নাই, তোমার ছেলেগুলি অন্যায়ের পয়সায় বেঁচে নাই–সতী সাধ্বী পত্নী তোমার ঘরে–তুমি তো রাজা।