বাঙালি খানা এখানে পাওয়ার উপায় নাই। পাঞ্জাবি খানাই খেতে হতো আমাদের। বাবুর্চিও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি। কিভাবে যে এই খাওয়া খেয়ে বেঁচে আছি জানি না। জান বাঁচানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন তাই খেতে বাধ্য হতাম। অনেক বলেও একজন বাঙালি বাবুর্চি রাখাতে পারলাম না।
তাদের কথা, সিকিউরিটির জন্য বাঙালি বাবুর্চি রাখা যায় না। একটা আশ্চর্য ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। এমনভাবে মাসের পর মাস এদের সাথে থাকার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। এখানে থাকবার সুযোগ পেয়ে দেখলাম বাঙালিদের তারা ব্যবহার করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিশ্বাস করতে রাজী নয়। আর বিশ্বাস করেও না। সকলকেই সন্দেহ করে। তাদের ধারণা প্রায় সকলেই নাকি আমার ভক্ত। মনে মনে সকলেই নাকি আলাদা হতে চায়। পূর্ব বাংলায় বাঙালির মুখ দেখতে পারি নাই কয়েকমাস এ কথা কি কেহ বিশ্বাস করবে? পাঁচ মাসের মধ্যে বাংলায় কথা বলতে পারি নাই। কারণ কেহই বাংলা জানে না। ঢাকা রেডিও এরা শোনে না। হয় কলম্বাে, না হয় দিল্লী-হিন্দি উর্দু গান শোনবার জন্য। বাংলা গান এরা বোঝে না বলেই শুনতে চায় না। বাংলা গান হলেই রেডিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। একজন বাঙালি ডাক্তার দেখতে আসতেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লা। নাম মেজর সফিক (ডা.)। তিনি কখনও একাকী আমাদের কামরায় আসতেন না। সাথে ডিউটি অফিসারকে নিয়ে আসতেন। কখনও বাংলায় কথা বলতেন না। ইংরেজি বা উর্দু। আমি তার চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি পূর্ব বাংলার লোক। বাংলায় আমি কথা বললে ইংরেজি বা উর্দুতে জবাব দিতেন। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, বোধ হয় বাংলা ভুলে গেছেন তাই উর্দু বলেন। তিনি বেহায়ার মত হাসতে লাগলেন। মনে হতো ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। পরে তার সম্বন্ধে জানলাম তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বিবাহ করেছেন। বাড়ির সাথে কোনো সম্বন্ধ নাই। নিজকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে ভয় পান। যদি কেহ মনে প্রাণে বাঙালি হয় তবে তার ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ। এই ষড়যন্ত্র মামলা ইনকোয়ারী শুরু হওয়ার পরে যে কয়েকজন সামান্য বাঙালি কর্মচারী সামরিক বাহিনীতে আছেন তাদের অবস্থা বড় করুণ। কখন যে গ্রেপ্তার হবে কে বলতে পারে। তাই তারা ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়।
থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কোনো বাঙালি কর্মচারী বা সিপাহি নাই। যে অফিসার মেসে আমাকে রাখা হয়েছে, সেখানে একজন বয় আছে যার উপর হুকুম আছে আমাদের কাছে আসতে পারবে না। আর একজন লোককে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখি, মালি। তাই বাংলা কথা বলার উপায় নাই-পূর্ব বাংলার মাটিতে থেকেও-একেই বলে অদৃষ্ট! প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরি আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্তই প্রায় ইংরেজি ও উর্দুতে। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু’ একখানা এনে দিতেন। ভদ্রলোকও খুব লেখাপড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না। যে কয়েকজন অফিসার আছেন তারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, তারাই আমার ডিউটি করতেন। বাঙালিদের বোধ হয় ডিউটি দেওয়া নিষেধ ছিল। অন্য কোনো রেজিমেন্টে বাঙালি দুই একজন থাকলেও আমার কাছে আসার হুকুম নাই।