আমিও কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি না। এই মেসে আর কোনো বন্দি আছে কিনা বুঝতে পারছি না। দরজাটা সকলেরই বন্ধ। এই কামরাটার খবর ছাড়া কিছুই জানি না। কারো কোনো চিঠি পাই না। রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে কি অবস্থায় আছে? আব্বা মা ভাই বোন কোথায় কি করছে, কেমন আছে? এমনিভাবে একাকী দিন কাটছে। কোনো খবর নাই। শরীরও দিন দিন খারাপ হতেছে। একদিন একজন কর্মচারী বলল, দিনভর বসে আর শুয়ে থাকবেন না, ঘরের ভিতর যে জায়গাটুকু আছে সেখানে হাঁটাচলা করুন। কথাটা আমার মনে ধরল। যদিও ছোট্ট কামরা, ৩ ঘণ্টা সকালে দুপুরে বিকালে আপন মনে হাটতাম। খোদা ছাড়া কেইবা সাহায্য করতে পারে! দেশের কোথায় কি হতেছে? দুনিয়ায় কি ঘটছে? কোনো কিছুর খবর নাই। কাগজ পড়া নিষেধ! রেডিও শুনতে পারব না। কারো সাথে কথা নাই। দিন কাটাও। মনে মনে ভাবতাম, আমি তো ৭/৮ বৎসর জেল খেটেছি, আমার অবস্থাই এই। আর অন্য কাহাকে এনে থাকলে তাদের অবস্থা কি হয়েছে? এনেছে অনেককে গ্রেপ্তার করে। তবে কতজন এবং তারা কারা? ২৮ জনের নাম দেখেছিলাম কাগজে। নতুন কাকেও এনেছে কিনা! দিনগুলি কি কাটতে চায়! তবুও কাটাতে হবে। বই পেয়ে একটু রক্ষা পেয়েছিলাম।
অতিথিশালায় আমি থাকি, আর মেসে অন্য কোনো হতভাগা আমার মতো আছে কিনা, খবর নেওয়ার উপায় নাই। কেহ কিছু বলে না। সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে আমাকে নিয়ে বাইরে কিছু সময় বেড়াবার হুকুম ছিল। আমি এই সময়টুকুর জন্য দিনভর অপেক্ষা করতাম। বাইরে যখন হাঁটতাম তখন দেখতে চেষ্টা করতাম কেহ আছে কিনা। একদিন দেখলাম তিনটা দরজা বন্ধ, অন্য দরজাগুলি খোলা। বুঝতে পারলাম বোধহয় আরও তিন হতভাগা এখানে আছে।
আমাকে সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে মেস এরিয়ার বাইরে একটা রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। একজন অফিসার আমার সাথে সাথে হাঁটতো আর দু’জন মিলিটারী রাস্তার দুইদিকে পাহারা দিত। কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারত না। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কয়েকদিন বেড়াবার পরে আমার একটু সন্দেহ হলো। মেস এরিয়ার মধ্যে এত জায়গা থাকতে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেওয়া হচ্ছে কেন? দু একজনের ভাবসাবও ভাল মনে হচ্ছিল না। একটা খবরও আমি পেলাম। কেহ কেহ ষড়যন্ত্র করছে। আমাকে হত্যা করতে। আমাকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারপর বলা হবে পালাতে চেষ্টা করেছিলাম, তাই পাহারাদার গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো জায়গাটা মেসের বাইরে। জনসাধারণ বা অন্য কাউকে দেখাতে পারবে যে আমি ভেগে বাইরে চলে গিয়াছিলাম তাই গুলি করা হয়েছে। আমি যে ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পেরেছি এটা কাহাকেও বুঝতে না দিয়ে বললাম, এরিয়ার বাইরে বেড়াতে যাবো না। ভিতরেই বেড়াব। ষড়যন্ত্রকারীরাও বুঝতে পারল যে আমিও বুঝতে পেরেছি। আমি অফিসারদের সামনেই বেড়াতাম। আর একটা খবরও পেয়েছিলাম পরে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নাকি বলে দিয়েছেন, আমার উপর যেন শারীরিক কোনো অত্যাচার না হয়। আমিও কথায় কথায় কর্মচারীদের জানাইয়া দিয়েছিলাম, আমার গায়ে যদি হাত দেওয়া হয় তবে আমি আত্মহত্যা করব। জানি ইহা একটি মহাপাপ। কিন্তু উপায় কি? মানসিক অত্যাচার যাহা করেছে তাহার চেয়ে গুলি করে মেরে ফেলা অনেক ভাল। দুই একজন ছাড়া থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সকলেই ভাল ব্যবহার করেছিল।
আমার সাথে আবহাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিষয় কেহই আলোচনা করত না। একজন অফিসার সর্বক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখতেন। আমি কি করি, কি অবস্থায় থাকি। মাঝে মাঝে দুই একজন সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক কর্মচারী আমার সাথে আলাপ করতে আসতেন জানবার জন্য। যাকে ইন্টারগেশন করা বলা হয়। আমার কোনো ধারণা নাই-কিছুই জানি না এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা সম্বন্ধে। তবে কথার ভিতর থেকে বুঝতে পারতাম আমার স্ত্রী সহ অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কিছুসংখ্যক সিএসপি অফিসার, দুই একজন পুলিশ অফিসার, একজন বিখ্যাত সাংবাদিককেও জড়িত করবার চেষ্টা চলছে। কিছু সংখ্যক অতি উৎসাহী সামরিক কর্মচারী একদম পাগল হয়ে গেছে বলে মনে হয়। বিরাট কিছু একটা হয়ে গেছে। দেশকে রক্ষা করবার সমস্ত দায়িত্বই যেন তাদের উপরই পড়েছে। একটু গন্ধ পেলেই হলো, আর যায় কোথায়-একদম লাফাইয়া পড়ে অত্যাচার করার জন্য। তাদের ধারণা পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহী। বুদ্ধি আক্কেল সকল কিছু পশ্চিম বাংলা থেকে চালান হয়ে ঢাকা আসে। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় পূর্ব বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য টাকা পয়সা জমিজমা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত। দুই একজন আমাকে কথায় কথায় বলেছে এখনও বাঙালিরা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত এবং তাদের উপরই নির্ভরশীল। কিন্তু কোথায় যে হিন্দুদের কর্তৃত্ব আমার জানা নাই। বর্ণ হিন্দুরা প্রায় সকলেই পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে গেছে, কিছুসংখ্যক নিম্ন বর্ণের হিন্দু আছে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটা কর্মচারীর ধারণা পূর্ব বাংলার লোক হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত।
কুর্মিটোলায় সামরিক বাহিনীর ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারই পূর্ব পাকিস্তানের হেডকোয়ার্টার। এখানে থাকলে বোঝা যায় যে কুর্মিটোলা একটা পাঞ্জাবি কলোনী। এখানে বাঙালি চোখে খুবই কম পড়ে। থার্ড পাঞ্জাব মেসে থাকতাম। সেখানে একজন মালি আর একজন বেয়ারা ছাড়া বাঙালি ওষুধ করতেও পাওয়া যায় না।