সন্ধ্যার পরে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। সমস্ত লাইট নিবাইয়া দেয়া হতো। যেখানে আমি হাঁটতাম তার দুই পাশে দুই সশস্ত্র সিপাহি পাহারায় রত থাকতেন। আর একজন অফিসার আমার সাথে হাঁটতেন। বড় দুঃখ হতো এই অফিসারটার জন্য, কারণ কথা বার্তা নাই, চুপচাপ আমার সাথে সাথে হাঁটতে হবে। সমস্ত দিন রাত্র দরজা বন্ধ। এই অবস্থায় কামরায় থাকার পরে যখন বাইরের হাওয়া গায়ে এসে লাগত তখন যে মনের অবস্থা কি হতো, কিভাবে প্রকাশ করব! বাইরের এই শীতল বাতাস আমার মনে যে কি আনন্দই না বয়ে দিত। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম না। আবার চিন্তা এসে ঘিরে ধরতো। কর্মচারীদের আলোচনায় বুঝতে পারতাম কোর্ট মার্শালে বিচার করে সকলকে ফাসি বা গুলি করে মেরে ফেলবে। সকল কিছুই সম্ভব। মনে মনে প্রস্তুত হতে চেষ্টা করছিলাম। একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই বলতে পারেন, ‘পাকিস্তান আর্মি, এয়ারফোর্স ও নেভী আইনটা কি?’ আমার তো কোনো ধারণা নাই। আমি সাধারণ নাগরিক, সামরিক বাহিনীর কর্মচারীও না। আমাকে কি করে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হলো।”
তিনি বললেন, আইনে আছে যদি কোনো নাগরিক সামরিক বাহিনীর কর্মচারীদের সাথে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তবে এই আইনে তাকেও গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।
বুঝলাম, ব্যাপারটা কি। তিনি অন্য কিছু বলতে চাইলেন না। কারণ তাদের আলাপ করা নিষেধ।
দিন কি কাটতে চায়? আমি ছাড়াও আর কোনো আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে এনেছে কিনা- কোনো খবর নাই।
জনাব রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আমার সাথে আবার দেখা করতে এলেন। বললেন, চিঠি আপনি দিতে পারেন, আমরা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছে পৌঁছাইয়া দিব।
আমি একটা খসড়া চিঠি লিখে রেখেছিলাম। তা পড়ে শোনালাম। তাহারা এই চিঠি নিতে রাজি হলেন না। বললেন, শেষের দিকে পরিবর্তন করলে নিতে পারি। বললাম, ঠিক আছে বলুন কি লিখতে হবে। ব্রিগেডিয়ার আকবর বললেন, আমি লিখে নিলাম। তারপর আর একটা কাগজে নূতন করে লিখে তার হাতে দিলাম। তারা বললেন, পিন্ডি যেয়ে চিঠি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছাইয়া দিব। তিনি কি বলেন তা আপনাকে জানাবো।
চিঠির শেষের প্যারাটা আমাকে বাধ্য করল লিখতে। না লিখে আমার উপায় ছিল না। ইজ্জতের ভয়তেই লিখতে হলো। আমাকে মিথ্যা মামলায় আসামী করে দেশের মঙ্গল হবে না। পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের কেহ বিশ্বাস করবে না। জনগণ বলবে, আমাকে অত্যাচার করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়েছে। ৬দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। ১২টা মামলাও দায়ের করেছে। আমার সহকর্মী খোন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন, আব্দুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম, আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
রিজভী সাহেব আমার বাড়িতে যেয়ে রেণুকে খবর দিয়ে এসেছেন, আর আমার বাড়িতে যে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ স্বরূপ কিছু তামাকও নিয়ে এসেছেন। বললেন, আপনার বাড়ির সকলে ভাল আছে। আপনিও ভাল আছেন বলে এসেছি।
একটু নিশ্চিন্ত হলাম এই জন্য যে আমি যে কোথায় কি অবস্থায় আছি কেউই জানে না। একাকী কামরায় রাত্রদিন থাকা যে কি ভয়াবহ অবস্থা তাহা ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না। দিন কাটতে চায় না। বাইরে যেয়ে একটু হাঁটাচলা করবো তারও উপায় নাই। সূর্যের আলোও গায়ে স্পর্শ করার উপায় নাই। লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি নিজেরই ধুতে হয়। বিছানা নিজেরই করতে হয়। ধোপা কাপড় নিয়ে যায়, তবে ইচ্ছা মাফিক সময় লাগায়। আর আমি তো লুঙ্গিই পরি। নিজেই ধুয়ে নেই। কাপড় ধুবার সাবান যাহা ছিল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন কি করি। গেঞ্জি তো রোজই ধুতে হয়। সাবান কোথায় পাওয়া যাবে? সাবান যখন ফুরিয়ে গেল তখন গায়ে দেওয়া সাবান দিয়েই গেঞ্জি ধুতে আরম্ভ করলাম। একদিন মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমার উপর পাহারারত ছিলেন। বললাম, সাবান পেতে পারি কেমন করে। টাকা আমার আছে, কিনবার অনুমতি থাকলে কিনে দিবার বন্দোবস্ত করলে বাধিত হব। তিনি একটি সাবান আমাকে আনাইয়া দিলেন। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম।
যেখানে থাকি সেখানকার আবহাওয়াও খুব ভয়াবহ বলে মনে হয়। মিলিটারি কাস্টডি কাকে বলা হয় তা তো পূর্বে জানতাম না। আমার থাকবার বন্দোবস্ত ভালই করা হয়েছে, কিন্তু যে খাবার দেয় তা খেতে আমার কষ্ট হয়। আমাশা রোগে অনেকদিন থেকে ভুগছি। রোজ রোজ গোস্ত ও রুটি খাই কেমন করে? পেটের ব্যথা শুরু হলো। ডাক্তার সাহেবরা আসেন ঔষধ দেন, কিছু দিন ভাল থাকি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন বললাম, রুটি আমি খেতে পারব না। আমাকে ভাত দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন। দু’ একদিন পরেই ভাতের বন্দোবস্ত হলো। তবে গোস্ত চলল। অফিসার মেসে আমার খাবার বন্দোবস্ত, সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী-মাছ খেতে পারে না। এইভাবেই দিন চললো। তবে দিনে তিন চারবার চা খাবার বন্দোবস্ত হয়েছিল। চা না হলে আমার অসুবিধা হয়। এরপরে লেফটেন্যান্ট রাজা নসরুল্লা আজাদ কাশ্মীরের লোক, আমার কাছে ডিউটিতে আসতো। ভদ্রলোকের মনে খুবই দয়া। আমাকে খুব শ্রদ্ধা করতো। কারো কাছ থেকে কোনো দিন খারাপ ব্যবহার পাই নাই। খাবার কথা উঠলে তারা বলতো, কি করব আমরা যা খাই তাই আপনাকে দেই। আমার শরীর যে ভাল না, তা তারা বুঝতে পারতো। কোনো বদনা বা লোটা না থাকায় খুবই অসুবিধা হতো। একদিন ক্যাপ্টেন ওয়াহিদকে বললে তিনি নিজে টাকা দিয়ে একটা বদনা কিনে দিলেন।