(পাঁচ মাস পরে খাতা পেয়েছি। তাই দিন তারিখগুলি আমার মনে নাই, ঘটনাগুলি যতদূর মনে পড়ে তাই লিখে রাখছি।)
পরের দিন সকাল ১১টার দিকে দু’জন ভদ্রলোক এলেন। তাদের জানি না, শুধু বুঝলাম সামরিক কর্মচারী হবেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কিছু জানি কিনা এই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে। করাচিতে জনাব ফজলুর রহমান সিএসপিসহ নৌ-বাহিনীর কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি কিনা? ষড়যন্ত্রকারীদের অর্থ সাহায্য করেছি কিনা? ঢাকায় জনাব রুহুল কুদুস সিএসপির সাথে একসাথে গোপন সভা করেছি কিনা? চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মী মানিক চৌধুরীকে অর্থ সাহায্য করতে বলেছি কিনা? আমি বললাম, আজ ২১ মাস আমি দেশরক্ষা আইনে বন্দি। আপনারা বিশ্বাস করেন কেমন করে যে আমি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে পারি? আমি কিছুই জানি না, কাহাকেও টাকা পয়সা দেই নাই। তাহারা চলে গেলেন, আমি খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় পড়ে রইলাম। রাত্রে খবর দেওয়া হলো মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আগামীকাল সকাল বেলা আসবেন আমার সাথে দেখা করতে।
দু’টা বই ছিল পড়ে ফেলেছি। এখন উপায় কি? সময় কাটবে কি করে? এতদিন শরীর কিছু ঠিক রেখেছিলাম এবার বোধ হয় আর পারলাম না।
পরের দিন সকাল ১০টায় মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর মেসে বসে ডিউটি অফিসার লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদ জাফরকে খবর দিলেন আমাকে মেসে নিয়ে যেতে। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। সূর্যের আলো তো গায়ে লাগে নাই এই কয়দিন, তাই বের হয়ে গেলাম। এক মিনিটের বেশি সময় লাগলো না পৌছতে। রিজভী সাহেবের নাম আমি শুনেছি, কিন্তু আলাপ ছিল না। যথারীতি আলাপ পরিচয় হওয়ার পরে আমাকে নিয়ে রৌদ্রে বসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়েছে? আপনারা তো আমার সম্বন্ধে জানেন। আমি তো গোপন ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। যাহা ভাল বুঝেছি তাহাই করেছি। স্বায়ত্তশাসনের দাবী তো ১৯৪৯ সাল থেকে আমি করতে শুরু করেছি। পার্লামেন্টে প্রাদেশিক আইন সভার বাইরে ও ভিতরে আমি প্রচার করেছি। তারপর ছয়দফা প্রোগ্রাম দিয়েছি ১৯৬৬ সালে। বই ছাপাইয়াছি, বক্তৃতা করেছি। আপনারা আমাকে ও আমার সহকর্মীদের দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে রেখে কতকগুলি মামলাও দায়ের করেছেন। আমি পাকিস্তানের অমঙ্গল কামনা করি নাই। দুই অঞ্চলকে আলাদা করতেও চাই নাই। কারণ সংখ্যাগুরু অঞ্চল সংখ্যালঘুদের ভয়ে আলাদা হতে পারে না। আর এমন কোনো নজির ইতিহাসে নাই। আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে আপনারা রাজনীতি করতে দিবেন না। ঠিক আছে আপনারা আমার একটা চিঠি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেবের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে রাজি আছেন কিনা? কারণ যতদূর আমার জানা আছে তিনি অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়ার পক্ষপাতী নন।
তাহারা বললেন, আমরা কি করব যদি অন্যান্য আসামিরা আপনার নাম বলে। আপনাকে এই মামলায় জড়িত আমরা করি নাই। অনেকেই আপনার নাম বলেছে। আপনি তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন এবং অন্যকে দিতে বলেছেন।
আমি বললাম, যাহা হবার হবে, তবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে আমার পত্রটা পৌঁছাইয়া দেন। কারণ পাকিস্তান দুই ভাগ হয়ে যাক আমি চাই নাই। যদি চাইতাম তবে প্রকাশ্যে বলতাম। তিনি ইচ্ছা করলে হস্তক্ষেপ করতে পারেন, কারণ আজ ২১ মাস আমি জেলে বন্দি। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছাড়া কারও সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না।
তাহারা বললেন, চিঠি আমরা নিতে পারব না। তবে যদি টেপরেকর্ডে আপনি কিছু বলতে চান বলে দিবেন—আমরা তাঁকে শুনাবো। রিজভী সাহেবকে আমার বাড়িতে খবর দিতে অনুরোধ করলাম যে আমি ভাল আছি এবং এখনও বেঁচে আছি। ব্রিগেডিয়ার আকবরকে বই দিতে অনুরোধ করলে তিনি ডিউটি অফিসারকে আমাকে বই পড়তে দিতে অনুমতি দিলেন, আর সন্ধ্যার পরে এক ঘণ্টা বাইরে বেড়াবার হুকুম দিলেন।
রিজভী সাহেব বললেন, “আপনার বাড়িতে আমি নিজেই যাবে এবং আপনার স্ত্রীকে বলে আসবো যে, আপনি ভাল আছেন। অসুবিধা নাই।” বললাম, “মেহেরবানি করে এই কাজটা করলে বাধিত হব।” খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হবে না, কারণ আইনে নাই।
তাহারা চলে গেলেন, আমিও কামরায় এসে ভাবতে বসলাম মানুষ স্বার্থের জন্য কিই না করতে পারে! শুনেছিলাম ভালবাসা ও রাজনীতিতে ভাল মন্দ বলে কোনো জিনিস নাই। আমি বিগ্রেডিয়ার আকবরকে বলেছিলাম, মনে রাখবেন এদেশের লোক বিশ্বাস করবে না আর করতে পারে না যে আমি ষড়যন্ত্র করতে পারি। আমার চরিত্র সম্বন্ধে তাদের ধারণা আছে। আমাকে জড়িত করে দেশের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই করলেন। দরজা বন্ধ। ঘরের মধ্যে বসে মনে মনে ভাবলাম, রাজনীতি জঘন্য রূপ ধরেছে। এর আর শেষ নাই। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে যে কোনো পন্থায় শেষ করার পথ অবলম্বন করেছে। লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদকে হুকুম দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার আকবর আমাকে বই দিতে। তিনি আমাকে একটা বই এনে দিলেন। রাত্রের ডিউটি অফিসার মেজর নাইমও আমাকে একটা বই দিলেন। বইটা তার নিজের। মেজর নাইম কুমিল্লায় থাকতেন। ঢাকা এসেছেন কিছুদিনের জন্য আমাদের দেখাশোনা বা পাহারা দিতে। আমি বইয়ের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারতাম না। অনেকগুলি পাতা পড়ে ফেলেছি, কিন্তু কি যে পড়েছি মনে নাই। আবার নতুন করে পড়তে হয়েছে।