আমি শুয়ে পড়লাম। আলো জ্বালান থাকলো। ঘুমের ব্যাঘাত তো নিশ্চয়ই হবে। তারপর মনের অবস্থা খারাপ। যাহা হউক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠতে দেরি হলো। রাত্রে যে ভদ্রলোক আমার কামরায় পাহারায় ছিলেন তিনি সকালবেলা চলে গেলে আর একজন ভদ্রলোক নাম লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদ জাফর ডিউটিতে এলেন।
দরজা জানালা বন্ধ। জানালা ও দরজার কাচগুলিকে লাল রং করে দেওয়া হয়েছে। ঘরগুলি অন্ধকার তাই আলো জ্বালাইয়া রাখতে হলো। দরজা বন্ধ থাকবে। এই কামরায়ই থাকতে হবে। কিছুই জানি না, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সময় কাটবে কি করে? বই পত্র নাই, খবরের কাগজ দেওয়া হবে না। যে অফিসার আমার পাহারায় রত থাকবেন তার উপর হুকুম আছে—পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামরিক কোনো বিষয়ই আলাপ করতে পারবে না। তবে আবহাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে হাঁ বা না সূচক ভাষায় উত্তর দিতে বোধ হয় আপত্তি নাই। কথা বার্তা না বলে দু’জন লোক একই কামরায় নীরবে বসে থাকতে হবে। আর অফিসার ভদ্রলোকের কাজ হলো আমাকে চোখে চোখে রাখা যাতে আমি ভাগতে চেষ্টা না করি বা আত্মহত্যা করতে না পারি। ভাবতে লাগলাম এই অবস্থায় দিন কাটবে কি করে! আর কতকাল থাকতে হয় ঠিক কি? এইভাবে থাকলে যে কোনো লোক পাগল হতে বাধ্য। তবুও তো থাকতে হবে। কারণ ‘পড়েছি পাঠানের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।‘
নাস্তা, দুপুর ও রাত্রের খাবার ঠিক সময় মতো এসে হাজির হয়। তবে দু’বেলাই রুটি। মহা সমস্যা। আমি আমাশয়ের রুগি। পেটের ব্যাথাও শুরু হয়ে পড়ল। জানতে পারলাম আমি যেখানে আছি এটা অফিসার মেস। আমার ঘরটা হলো গেস্ট হাউস। অফিসাররা যা খেয়ে থাকেন আমাকেও তাই খেতে দেওয়া হয়। সমস্ত কর্মচারীই হলো পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী, তারা রুটিই খেয়ে থাকে। সাথে থাকে মাংস। রুটি মাংস ও ডাল খেয়ে আমার পক্ষে বাচা কষ্টকর। উপায় নাই। যতদিন চলে চালাতে হবে। আমার কাছে দুইখানা মাত্র বই ছিল। অন্য বইগুলি জেলখানায় রেখে এসেছি। ভুল করেছি বই না এনে। অফিসার ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, বই পড়তে আপত্তি আছে কিনা। তিনি বললেন, বই দেওয়ার হুকুম আপাতত পাই নাই। তবে আপনার কাছে থাকলে পড়তে পারেন। তিনি মাঝে মাঝে বাইরে যান। আমি যে কড়িকাঠ গুনবো সে ব্যবস্থাও নাই। কারণ কড়িকাঠও দালানে নাই। আলো জ্বালানই ছিল। সুকর্ণর পতন সম্বন্ধে বই দুটি পড়তে লাগলাম। কিন্তু মন বসছে না, নানা চিন্তা ঘিরে ধরছে। কি করব বসে বসে শুধু পাইপ খেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম রাজনীতি এত জঘন্য হতে পারে! ক্ষমতার জন্য মানুষ যে কোনো কাজ করতে পারে। আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে কারো বিবেকে দংশন করল না। আমি তো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি নাই। জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি। যাহা ভাল বুঝেছি তাই বলেছি। বক্তৃতা করে বেড়াইয়াছি, গোপন কিছুই করি না বা জানি না। সত্য কথা সোজাভাবে বলেছি তাই সোজাসুজি জেলে চলে গিয়াছি। কাহাকে ভয় করে মনের কথা চাপা রাখি নাই। যে পথে দেশের মঙ্গল হবে, যে পথে মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তাহাই করেছি ও বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যাতে তার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারে তার জন্য আন্দোলন করেছি। বার বার জেলে যেতে হয়েছে আর মামলার আসামী হতে হয়েছে। কিন্তু মনের কথা চাপা রাখি নাই। জেলে যেতে হবে জেনেও ছয় দফা জনগণের কাছে পেশ করেছিলাম। যদিও জানা ছিল শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর আঁতে ঘা লাগবে। ঝাপাইয়া পড়বে আমার ও আমার সহকর্মীদের উপর। অত্যাচার চরম হবে, তবুও গোপন করি নাই। আজ দুঃখের সাথে ভাবছি আমাকে গোপন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে শাসকদের একটু বাঁধলো না! এরা তো আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ভাল করে জানে। ভাবা ও চিন্তা করা ছাড়া কোনো কাজই যখন নাই যখন মনকে বললাম, ভাবো যত পারো, কিন্তু পাগল করো না। জীবনের বহু কথা মনে পড়তে লাগলো। খাতা কাগজ নাই যে কিছু লেখব। কলম আছে। কাগজ ও খাতা পাওয়ার কোনো উপায়ও নাই, আর অনুমতিও নাই।
আমাকে ছাড়া অন্য কাহাকেও গ্রেপ্তার করেছে কিনা? পূর্বে ২৮ জন গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন জেলে ছিল। ঢাকা জেলে প্রায় ২০/২২ জন ছিল। তাদেরও এখানে এনেছে কিনা? জানার উপায় নাই। কে কোথায় আছে কিছুই বলতে পারি না। পূর্বের ২৮ জন, আমি ছাড়াও নূতন গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা?
কামরার সামনে একজন রাইফেলধারী সিপাহি ও পিছনে একজন দাঁড়াইয়া আছে সর্বক্ষণের জন্য। মিলিটারি কাস্টডি কাকে বলে পূর্বে ধারণা ছিল না। প্রথম দিন এইভাবে কেটে গেল। পরের দিন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী এলেন আমার কামরায়। তাকে আমি জানি না। তিনি আমাকে বললেন, কোনো অসুবিধা আছে কিনা? বললাম, জানলাটা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, না হলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে কি করে? তিনি জানলা খুলে দিতে হুকুম দিয়ে চলে গেলেন। আমি সেই অন্ধকার কামরায় বসে বসে খোদাকে ডাকা ছাড়া কি করতে পারি! রাত্রে আর একজন কর্মচারী এলেন তার নাম মেজর নাইম। এরা সকলেই প্রায় থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কর্মচারী। আমি এদেরই মেসে আছি। ইনি কুমিল্লা থেকে এসেছেন, সেখানেই তার পোস্টিং, যথারীতি পরিচয় হওয়ার পরে কোনো কথাবার্তা না বলে চুপ করে বসে থাকতে হয়। পাইপ খাওয়া বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক। কয়েক টিন তামাক আমার কাছে। আছে। মাস দেড়েক চলতে পারে। ভাবলাম রেণু ও ছেলেমেয়েদের দেখা করতে দিবে না, তামাক আসবে কি করে! তাহারা নাও জানতে পারে আমি কোথায় আছি। আর জানলেও পাঠাবে কি করে? স্থির করলাম যে কয়েকদিন তামাক আছে খেতে থাকি, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিব। বাবা-মা, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বাড়ির স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সকলকে ছেড়ে থাকতে পারি আর তামাক ছেড়ে থাকতে পারব না! দুই দিন পরে সকালে আর একজন ভদ্রলোক এলেন সাদা পোশাক পরিহিত। বললেন দু’ একদিনের মধ্যে অফিসাররা আসবে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তারপর জনাব রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন। আমি তাকে যথারীতি ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।