আমাকে কোনো লিখিত আদেশ দিল না। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের কাছ থেকে টাকাগুলি বুঝে নিয়ে রওয়ানা করছি, এমন সময় ঢাকা জেলের জেলার ফরিদ আহম্মদ হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে বললেন, “আপনাকে তো আমরা ছাইড়া দিলাম।” এই ভদ্রলোকের কথায় আমার প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল এবং কড়া উত্তর দিবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। শুধু বললাম, বাজে কথার দরকার নাই। এই ভদ্রলোকের উপর রাগ করে লাভ নাই, কারণ একে আমি পূর্বের থেকেই জানতাম। এই জেলেই কয়েক বৎসর পূর্বে ডিপুটি জেলার ছিল। তখনও আমি রাজবন্দি ছিলাম। এখন জেলার হিসেবে কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। তাহার ব্যবহার সম্বন্ধে সকলেরই ধারণা আছে। নানা কারণে অন্যান্য কর্মচারী ও কয়েদিরা একে মোটেই দেখতে পারে না। আর সত্যই দ্রলোক কথা বলতেও জানে না।
আমি জেলগেটে দেখলাম ঢাকা জেলের সুপারেনটেনডেন্ট বা ডিআইজি সাহেবের রুমে আলো জ্বলছে। তিনিও এই সময় উপস্থিত হয়েছেন—বোধ হয় আমাকে ‘মুক্তি দিবার জন্য’।
জেলের লোহার দরজা খুলে দেওয়া হলো। সামনেই একটি গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। চারদিকে সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা পাহারায় রত আছেন। একজন মেজর সাহেব আমাকে গাড়িতে উঠতে বললেন। আমি গাড়ির ভিতরে বসলাম। দুই পার্শ্বে দু’জন সশস্ত্র পাহারাদার, সামনের সিটে ড্রাইভার ও মেজর সাহেব। গাড়ি নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে রমনার দিকে চলল। আমি পাইপ ধরাইয়া রাত্রের স্নিগ্ধ হাওয়া উপভোগ করতে লাগলাম, যদিও শীতের রাত। ভাবলাম কোথায় আমার নূতন আস্তানা হবে! কোথায় নিয়ে যাওয়া হতেছে! কিছুই তো জানি না। গাড়ি চললো কুর্মিটোলার দিকে।
বহুকাল পরে ঢাকা শহর দেখছি, ভালই লাগছে। মনে মনে শেরে বাংলা ফজলুল হক, জননেতা সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীনের কবরকে সালাম করলাম। চিরনিদ্রায় শুয়ে আছ, একবারও কি মনে পড়ে না এই হতভাগা দেশবাসীদের কথা! শাহবাগ হোটেল পার হয়ে, এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে।
এয়ারপোর্ট ত্যাগ করে যখন ক্যান্টনমেন্ট ঢুকলাম তখন আর বুঝতে বাকি রইল না। মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, “তোমাকে আমি ভালবাসি। মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা।”
অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো। বিশেষ করে আমার আব্বা ও মায়ের কথা। খবর পেলে এই বৃদ্ধ বয়সে দুইজনের কি অবস্থা হবে? আব্বার বয়স ৮৪ বৎসর আর মায়ের বয়স ৭৫ বৎসর। আর কতদিনই বা বাঁচবেন! দুঃখ পেয়ে আঘাত সহ্য করতে না পারলে যে কোনো অঘটন হয়ে যেতে পারে। বোধ হয় আমি আর দেখতে পাব না। এর মধ্যেই এসে পৌছলাম একটা ঘরের সামনে। এখানেও সামরিক বাহিনী পাহারা দিতেছে। দরজা খুলে দিল। আমি নেমে পড়লে আমাকে সাথে করে একটা কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে তিনজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারী দাঁড়াইয়া আছেন। আমার সাথে কেহ কোনো আলাপ করলেন না, আমিও চুপ করে দাঁড়াইয়া রইলাম। কয়েক মিনিট পরে বললাম, শরীর ভাল না, কোথাও বসতে অনুমতি দিন। আমাকে পাশের আর একটা কামরায় নিয়ে বসতে দেওয়া হলো। কয়েক মিনিট পরে এক ভদ্রলোক এলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ষড়যন্ত্র ব্যাপার সম্বন্ধে। বললাম, কিছুই জানি না।
এর মধ্যে এক ভদ্রলোক বলিষ্ঠ গঠন, সুন্দর চেহারা, আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তিনি একজন ডাক্তার। আমার হার্ট পেট রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন। কিছুই না বলে চলে গেলেন পাশের কামরায়। কয়েক মিনিট পরে আর একজন কর্মচারী এসে বললেন, চলুন। একটা জীপ গাড়িতে করে আমাকে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। এক কামরাবিশিষ্ট একটা দালান। সাথে গোসলখানা, ড্রেসিং রুম, স্টোর রুম আছে। দু’খানা খাট পাশাপাশি। একটা খাটে একটা বিছানা আছে। আর একটা খাট খালি পড়ে আছে। আমাকে বলা হলো আপনার মালপত্র এসে গেছে দেখে নেন। বিছানা খুলে বিছানা করে নিলাম। একজন কর্মচারী—যার নাম লেফটেন্যান্ট জাফর ইকবাল সাহেব, তিনি আমার পাশের খাটেই ঘুমাবেন সামরিক পোশাক পরে-সাথে রিভলবার আছে। লেফটেন্যান্ট সাহেব একাকী প্যাসেন্স খেলতে লাগলেন। আমি বিছানায় বসে পাইপ টানতে লাগলাম, কোনো কথা নাই। কুর্মিটোলার কোন জায়গায় আমি আছি নিজেই জানি না।
আধা ঘণ্টার মধ্যে সেই দু’জন সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক কর্মচারী এলেন—যাদের সাথে পূর্বেই দেখা হয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো অসুবিধা আছে কিনা? এখানেই আপাতত আমাকে থাকতে হবে। আমাকে চা খেতে অনুরোধ করলেন। আমি আগ্রহের সাথে রাজি হলাম। কারণ ঘুম ভাঙাইয়া আমাকে নিয়ে এসেছে, জড়তা এখনও যায় নাই। তিনজন এক সাথে চা খেলাম। আমি বললাম, “আমাকে কেন আপনারা এনেছেন জানি না, তবে সত্য চাপা থাকবে না। অন্যায় ভাবে আমার উপর অত্যাচার করে কি লাভ হবে বুঝতে পারছি না।” একজন মনে হলো—মেজর হবে, একটু টিটকারী দিয়ে কথা বলছিলেন, এমনকি আমার স্ত্রীও জড়িত আছে এমন ইঙ্গিতও দিতে ভুল করলেন না। আমি তাহাকে লক্ষ্য করে বললাম, “দেখুন, আমার স্ত্রী রাজনীতির ধার ধারে না। আমার সাথে পার্টিতে কোনো দিন যায় নাই। সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাইরের লোকের সাথে মেলামেশাও করে না। আমার রাজনীতির সাথে তার সম্বন্ধ নাই।” এই সময় আমি দেখলাম আর একজন ভদ্রলোক যিনি কর্নেল হবেন বলে মনে হলো, অন্য আর একজনের দিকে চেয়ে ইশারা দিয়ে নিষেধ করল। কর্নেল ভদ্রলোকের নাম পরে জানতে পারলাম শের আলি বাজ। খুবই ভদ্র, অমায়িকভাবে আলোচনা করছিলেন। কর্নেল শের আলি বাজ যাবার সময় বলে গেলেন, থাকবার খাবার কোনো অসুবিধা হবে না। ভদ্রলোকের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো আক্রোশ খুঁজে পেলাম না। পরে জানতে পারি এর বাড়ি পেশওয়ার জেলায়।