প্রথম খবর পাই জেলের মধ্যে ঈদের নামাজে। এই দিন বিভিন্ন ওয়ার্ডের বন্দিরা কিছু সময়ের জন্য এক জায়গায় নামাজ পড়তে জমা হয়। আমাকে দেখে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী কেঁদে ফেলে এবং বলে তাকে ২১ দিন পুলিশ কাস্টডিতে রেখেছিল। মেরে পা ভেঙে দিয়েছে। তারপর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা করে একটু আরোগ্য লাভ করলে জেলে পাঠাইয়া দিয়েছে। আমাকে জড়াইয়া ধরে কেঁদে দিয়ে বলল, শুধু আপনার নাম বলাবার জন্য আমাকে এত মেরেছে, সহ্য করতে পারি নাই বলে যাহা বলেছে। তাহাই লিখে দিয়ে এসেছি। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম আর বললাম, আল্লার উপর নির্ভর কর। যাহা হবার হবেই। আমাকে বলল, সরকারের কাছে দরখাস্ত করব।
ফজলুর রহমান সিএসপিও বলল, আপনাকে জড়াবার খুব চেষ্টা চলছে। আরও দুই একজন ভূতপূর্ব সামরিক বাহিনীর কর্মচারীও আমাকে বলল। এর মধ্যে মি. কামালউদ্দিন নামে একজন ভূতপূর্ব নৌ-বাহিনীর কর্মচারীর পুরানা ২০ সেল থেকে জেল গেটে যাবার সময় আমার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে আদাব করলেন। আমি বললাম, আপনাকে তো কোনোদিন দেখি নাই, আপনি কে? বলল, আমার নাম কামালউদ্দিন। পুলিশ হাজতে নিয়ে অসম্ভব মেরেছে। সমস্ত শরীর পচাইয়া দিয়েছে। সোজাভাবে শুয়ে থাকতে পারি না। পায়খানার দ্বারের মধ্যে কি ঢুকিয়ে দিয়েছিল যন্ত্রণায় অস্থির। এই দেখুন জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে জায়গায় জায়গায় পোড়াইয়া দিয়েছে : আপনার নাম লেখাইয়া নিয়েছে আমার কাছ থেকে যদিও অনেক বলেছি যে ‘শেখ মুজিবের সাথে আমার পরিচয় নাই। একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ লাইনেই উপস্থিত আছেন, টাইপ করে কাগজ দেয়, তাই পড়ে দিয়ে আসতে হয়। না পড়লে আবার মারতে শুরু করে। কি করব স্যার, লিখে দিয়ে এসেছি, তবে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস করব। সেখানে সব বলব। মামলা সে করেছিল, খবরের কাগজে অত্যাচারের করুণ কাহিনী প্রকাশ হয়ে পড়েছিল কামাল উদ্দিনের মামলায়। এরপরে জেলে বসে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেসনোট পড়লাম, তাতে ২৮ জনের নাম দিয়েছে। জনাব রুহুল কুদুস সিএসপি ও ফজলুর রহমান সিএসপি সহ সামরিক বেসামরিক লোকের নাম রয়েছে। তিনজন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মীর নামও দেখলাম। প্রেসনোটে লেখা ছিল এই ২৮ জন লোকই ষড়যন্ত্র করেছে। মোমিন সাহেবকে বললাম, বোধ হয় চিন্তা ভাবনা করে আমাকে বাদ দিয়েছে, কারণ আজ ১৭ মাস আমি কারাগারে বন্দি। এতবড় মিথ্যা কথা সরকার বলবে কেমন করে! তিনি ও অন্যান্য রাজবন্দিরা জানতে পেরেছিলেন বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের থেকে—যে আমাকে জড়াবার চেষ্টা চলেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আমাকে খবরও পাঠাইয়াছিল। আমার সাথে দেখা করতে এসে রেণু (আমার স্ত্রী) আমাকে বলেছিল, তোমাকে জড়াবার চেষ্টা হতেছে। জানি না খোদা কি করে। আল্লার উপর নির্ভর কর।
আমি বললাম, দেশরক্ষা আইনে জেলে রেখেছে, ১১টা মামলা দায়ের করেছে আমার বিরুদ্ধে। কয়েকটাতে জেলও হয়েছে, এরপরও এদের ঝাল পড়ল না। ৬ দফার ঝাল এতো বেশি জানতাম না। আইবি ও জেল অফিসার সামনে বসে থাকে, কথা বলা যায় না। আমার শরীরও খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল, কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, হাসপাতালে যেতে হয় নাই, তবে ভর্তি করে খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করেছিল। অনেক ওজন কম হয়ে গিয়েছিল। একটু আরোগ্য লাভ করেছিলাম। তখনও ভর্তি ছিলাম যেদিন আমার মুক্তির আদেশ নিয়ে ডিপুটি জেলার রাত ১২টায় হাজির হয়েছিলেন।
ডিপুটি জেলার হুকুমনামা নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন। আমি পড়ে দেখলাম, দেশরক্ষা আইন থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মোমিন সাহেব প্রথমে খুশি হয়েছিলেন পরে তিনি বুঝতে পারলেন ভিতরে কিছু কিন্তু আছে। বিছানা কাপড়গুলি বেঁধে দিল কয়েদিরা। মোমিন সাহেবকে বললাম, বাড়িতে রেণুকে খবর দিতে, আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়াছে। আমি দেখলাম, ডিপুটি জেলার ও সিপাহি জমাদার, যারা আমাকে ও মালপত্র নিতে এসেছে তাদের মুখ খুব ভার। কারো মুখে হাসি নাই। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে, অন্য কোনো বিপদে আমাকে ফেলছে সেটা আর কিছু না, ষড়যন্ত্র মামলা’। বিদায় নিবার সময় মোমিন সাহেবকে বললাম, বোধ হয় আর আপনাদের সাথে দেখা হবে না। আপনারা রইলেন এদেশের মানুষের জন্য, আমি চললাম। খোদা আপনাদের সহায় আছেন। আমাকে যারা খানা পাকাইয়া খাওয়াতো, কাজ করে দিত, তাদের কাছ থেকেও ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়ে প্রায় ১টার সময় জেলগেটে হাজির হলাম।
বইখাতা ও খাবার জিনিসপত্র রেখে এলাম। বলেছিলাম, আপনাদের জিনিসগুলি রেখে আমার জিনিসপত্র কামালকে (আমার বড় ছেলে) খবর দিলে নিয়ে যাবে এসে। আমাকে কোথায় নিয়ে যায় ঠিক নাই।
জেলগেটে এসেই দেখি এলাহি কাণ্ড! সামরিক বাহিনীর লোকজন যথারীতি সামরিক পোষাকে সজ্জিত হয়ে দাঁড়াইয়া আছেন আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের রুমে এসে বসতেই একজন সামরিক বাহিনীর বড় কর্মকর্তা আমার কাছে এসে বললেন, “শেখ সাহেব আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমি তাকে বললাম, নিশ্চয় আপনার কাছে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে। আমাকে দেখালে বাধিত হব। তিনি একজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারীকে বললেন, পড়ে শোনাতে। তিনি পড়লেন, “আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।” আমি বললাম, ঠিক আছে, চলুন কোথায় যেতে হবে। সামরিক বাহিনীর কর্মচারী বললেন, “কোনো চিন্তা করবেন না, আপনার মালপত্র আপনি যেখানে থাকবেন সেখানে পৌঁছে যাবে।”