২২শে জুন খবরের কাগজে দেখলাম নারায়ণগঞ্জের বজলুর রহমান, ঢাকার হারুনুর রশিদ, তেজগাঁর মাজেদুল হক, রাজশাহী থেকে মুজিবুর রহমান, সিলেট থেকে জালালউদ্দিন সাহেব, দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সিরাজউদ্দিন, টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ আলি, খুলনার শেখ মোহাম্মদ আলি, চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরীকে মুক্তি দেওয়ার হুকুম দিয়েছে। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতা। যাহা হউক সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, ছাড়তে যখন শুরু করেছে কিছু কিছু লোককে ছাড়বে।
২৫ তারিখে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হকও মুক্তি পেয়েছে। বেগম সাহেবা এসেছিলেন আমার বড় বোনকে সাথে নিয়ে। আমাকে দেখেতো কেঁদেই অস্থির। বললাম, “বুজি, তুমি কাঁদ কেন? আমার সত্যই কোনো কষ্ট হয় না। আর ভিতর বাইরে সবই সমান। যারা দেশ চালায় তাদের অনেকের মধ্যে দয়া মায়া তো দূরের কথা মনুষ্যত্বও নাই। চিন্তা করিও না।”
আমার বড় বোন ১৯ বৎসর বয়সে বিধবা হয়েছে। একটা মেয়ে কোলে আর একটা ছেলে পেটে ছিল যখন ভগ্নিপতি মারা যান। আমার ভাগ্নে আজ বড় হয়ে অর্থশালী হয়েছে, তিনটা ছেলেমেয়ে হয়েছে। আজও আমার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলে না। দেখা করতে এসে একদিন ছোট বাচ্চার মত কেঁদেছিল আর বলেছিল, “মামা ভাববেন না। মামী ও বাচ্চাদের যত টাকা লাগবে আমি দিব।” ওর টাকাও আছে, প্রাণও আছে।
৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!
দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।
৭. ১৯৬৮ সালের খাতাটির মাত্র ৫২ পৃষ্ঠা লেখা
[১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি রাত ১২টার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়। কারাগারের গেট দিয়ে বাইরে এলে সেনাবাহিনীর লোকজন তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করে রাখে। এসময় বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের কোনো সংবাদ বাইরে প্রকাশ না হওয়ায় তিনি বেঁচে আছেন কিনা জনগণের মনে সে বিষয়ে সন্দেহ, সংশয় ও উদ্বেগ দেখা দেয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টার কুর্মিটোলা অফিসার মেসের ১০নং কক্ষে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি অবস্থায় এই স্মৃতিকথা লেখা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবাঙালি সদস্যরা তাকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রেখেছিল।
পাঁচ মাস পর দুঃসহ বন্দি জীবনযাপনের সময় এই খাতাটি বেগম মুজিব তাকে পাঠিয়েছিলেন। রয়েল স্টেশনারি সাপ্লাই হাউজের ৩২০ পৃষ্ঠার রুল টানা খাতাটির মাত্র ৫২ পৃষ্ঠা লেখার তিনি সুযোগ পান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হবার পরই প্রথম পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আর তখনই এই খাতাখানা দেয়া হয়। তবে মামলা চলার কারণে তিনি খুব বেশি লিখতে পারেন নাই। এটা তার লেখা শেষ খাতা।]
————-
১৯৬৬ সালের ৮ই মে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে দিন যাপন করতেছিলাম।
১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি রাত্রে যথারীতি খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি। দেওয়ানি ওয়ার্ডে আমি থাকতাম। দেশরক্ষা আইনে বন্দি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিন এডভোকেট আমার কামরায় থাকতেন। ১৭ মাস একাকী থাকার পরে তাকে আমার কাছে দেওয়া হয়। একজন সাথী পেয়ে কিছুটা আনন্দও হয়েছিল। হঠাৎ ১৭ই জানুয়ারি রাত্র ১২টার সময় আমার মাথার কাছে জানলা দিয়ে কে বা কারা আমাকে ডাকছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখি নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল সাহেব দাঁড়াইয়া আছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, এত রাত্রে কি জন্য এসেছেন? তিনি বললেন, দরজা খুলে ভিতরে এসে বলব। ডিউটি জমাদার দরজা খুলে দিলে তিনি ভিতরে এসে বললেন, আপনার মুক্তির আদেশ দিয়েছে সরকার। এখনই আপনাকে মুক্ত করে দিতে হবে। মোমিন সাহেবও উঠে পড়েছেন। আমি বললাম, হতেই পারে না। ব্যাপার কি বলুন। তিনি বললেন, সত্যই বলছি আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে-এখনই, কাপড় চোপড় নিয়ে চলুন। আমি আবার তাকে প্রশ্ন করলাম, আমার যে অনেকগুলি মামলা রয়েছে যার জামানত নেওয়া হয় নাই। চট্টগ্রাম থেকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট রয়েছে, আর যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা থেকে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট রয়েছে। ছাড়বেন কি করে? এটাতো বেআইনি হবে। তিনি বললেন, সরকারের হুকুমে এগুলি থাকলেও ছাড়তে পারি। আমি তাকে হুকুমনামা দেখাতে বললাম। তিনি জেল গেটে ফিরে গেলেন হুকুমনামা আনতে।
আমি মোমিন সাহেবকে বললাম, মনে হয় কিছু একটা ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। হতে পারে এরা আমাকে এ জেল থেকে অন্য জেলে পাঠাবে। অন্য কিছু একটাও হতে পারে, কিছুদিন থেকে আমার কানে আসছিল আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়াইবার জন্য কোনো কোনো মহল থেকে চেষ্টা করা হতেছিল। ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক সামরিক, সিএসপি ও সাধারণ নাগরিক গ্রেপ্তার হয়েছে দেশরক্ষা আইনে-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা উপলক্ষ্যে, সত্য মিথ্যা খোদাই জানে!