আড়াইটার সময় ফিরে এলাম। গোসল করে খাবার খেয়ে কাগজ নিয়ে বসলাম। পাঁচটায় আবার গেটে যেতে হলো। রেণু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। হাচিনা পরীক্ষা ভালই দিতেছে। রেণুর শরীর ভাল না। পায়ে বেদনা, হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ৬ দফা মানতে হবে-সংগ্রাম, সংগ্রাম–চলবে চলবে-পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, “ও শিখলো কোথা থেকে?” রেণু বলল, “বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে।” বললাম, “আব্বা, আর তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক।” জামাল খুলনা থেকে ফিরে এসেছে। রেহানা খুলনায় যাবার জন্য অনুমতি চায়। বললাম, স্কুল বন্ধ হলে যাইও। কামালও বাড়ি যেতে চায় আব্বাকে দেখতে। বললাম, “যেও। কোথা থেকে যে সময় কেটে যায় কি বলব? জেলে সময় কাটতে চায় না, কেবল দেখা করার সময় এক ঘণ্টা দেখতে দেখতে কেটে যায়। ছেলেমেয়েরা বিদায় নিয়ে চলে গেল, আমিও আমার চির পরিচিত দেওয়ানী ওয়ার্ডের দিকে চললাম। ওবায়েদ কোর্টে গিয়াছিল দেখা হয়ে গেল পথে। বললাম, “খবর কি?” ওবায়েদ বলল, আপনার যাহা মত আমাদেরও সেই মত।
শাহ মোয়াজ্জেম ও নূরে আলম মাঠের মধ্যে বেড়াইতেছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এল। জিজ্ঞাসা করল, ভাবি কেমন আছে। বললাম, আমার শরীর খারাপ হওয়াতে বোধ হয় তারও শরীর খারাপ হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুতে হলো। দরজা বন্ধ করতে আসবে। জমাদার চাবি নিয়ে হাজির। সব বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও ভিতরে চলে গেলাম। খট করে বন্ধ হয়ে গেল বাইরের তালা। আমিও চা খেয়ে বই নিয়ে বসলাম।
২৮ তারিখের কাগজে দেখলাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর ও ফতুল্লা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে—যাতে ৭ই জুন ৬ দফা দাবি দিবস’ পালন করতে না পারে। বুঝতে আর কষ্ট হলো না।
সংবাদ ও ইত্তেফাক বন্ধ করার ব্যাপার নিয়েও আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটাকে দমাতে হবে। এটাই হলো সরকারের উদ্দেশ্য।
আর একটা আশ্চর্য জিনিস আজ কাগজে দেখলাম, কলেজগুলির অনুমোদন নিতে হবে সরকারের থেকে। ইংরেজকেও হার মানাইয়া দিয়েছে এই সরকার। কলেজের অনুমোদন দিত বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজ আমল থেকে এ পর্যন্ত চলছিল এই নীতি। হঠাৎ সরকারের হাতে এই ক্ষমতা নেওয়ার অর্থ বুঝতে কারই বা কষ্ট হয়! ভুল করছেন, বুঝতে পারছেন না! বাঁধন শক্ত হলে ছিড়েও তাড়াতাড়ি।
শাহ মোয়াজ্জেম একটা বই লিখেছে, আমায় পড়ে শোনাল। ভালই লিখেছে, অনেকক্ষণ ওর সাথে আলাপ হলো আজ। বোধ হয় ৫/৭ দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে জেল থেকে চলে যাবে। আবার একলা পড়ে যাবো। মাঝে মাঝে ২০ সেল ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি চাই ওর মুক্তি হউক। আমার এই জীবনটাই একাকী কাটাতে হবে এই নিষ্ঠুর ইটের ঘরে।
২৯শে মে—৩১শে মে ১৯৬৭
যে মামলায় আমাকে ১৫ মাস জেল দিয়েছে জনাব আফসার উদ্দিন আহম্মেদ জেল গেটে কোর্ট করে, সেই মামলায় আমাকে জেলা জজ বাহাদুর জামিন দিয়েছে খবরের কাগজে দেখলাম। জামানতের কাগজ আজও জেল গেটে আসে নাই। দুই একদিনের মধ্যেই আসবে বলে মনে হয়। আবার রাজনৈতিক বন্দি হয়ে যাবো। এক মাসের বেশি বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করলাম। রেণু এসেছিল জেল গেটে মণিকে দেখতে। ছেলেমেয়েরা ভালই আছে। মাংস মাছ পাকাইয়া নিয়ে এসেছিল, গেট থেকে পাঠাইয়া দিয়েছে। গরম করে করে দুইদিন এগুলিই খেলাম। শাহ মোয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম ও চিত্ত বাবুকে রেখে তো খেতে পারি না, তাদেরও ভাগ দিলাম। আজ দিলাম অন্যান্য সকলকে। বড় ভাল লাগে সকলকে দিয়ে খেতে। কয়েদিদের একঘেয়ে পাক খেতে খেতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে একটু পরিবর্তন হলে ভালই হয়। রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে ঘরের জিনিস আনার হুকুম নাই। তবে কয়েদি হলে আনতে পারে। বিচিত্র দেশ, বিচিত্র আইন! রাজনৈতিক বন্দিদের ফল ফলাদি আনারও হুকুম নাই। আজ কাগজ দেখে ভীষণ আঘাত পেলাম। খবরটা পেয়ে আমার কথা বলাও বন্ধ হয়ে গিয়াছিল। ভাবতেও কষ্ট হয় বন্ধু সহকর্মী ডা. গোলাম মওলা ইহজগৎ ছেড়ে চলে গিয়াছেন। ডা. মওলা এমএসসি এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার ছিল। আমার সাথে পরামর্শ করে মাদারীপুরে প্র্যাকটিস করত। যেমন চেহারা তেমনি স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিল। মাত্র ৪৩ বৎসর বয়স হয়েছিল। এত ভাল স্বভাব ও মধুর ব্যবহার খুব অল্প লোকেরই আমি দেখেছি। মাদারীপুরের নড়িয়া থেকে ১৯৫৬ সালে এমএনএ হয়। ১৯৬২ সালে আবার আইয়ুব সাহেবদের পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। একদিনের জন্যও দলত্যাগ করে নাই। দেশের লোক তাকে ভালবাসতো। দলমত নির্বিশেষে সকলেই তাকে তার ব্যবহারের জন্য সম্মান করত ও ভালবাসতো। ডাক্তার হিসেবে তার যথেষ্ট নাম ছিল। দেশ একজন নিঃস্বার্থ নেতাকে হারাল। আর আমি হারালাম আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহকর্মীকে। কিছুই করতে পারব না শুধু খোদাকে ডাকা ছাড়া। বন্দি জীবনে এই সমস্ত খবর খুব কষ্ট দেয়। ডা, মওলার চেহারা বার বার ভেসে উঠছিল আমার চোখের সামনে। আমাদের সকলকেই তোমার পথের সাথী একদিন হতে হবে মওলা। দুই দিন আগে আর পরে। তোমার আত্মা শান্তি পাক এই দোয়াই খোদার দরবারে করি।
২২শে জুন ১৯৬৭ ॥ বৃহস্পতিবার