বহু রাত্রে ঘুমাতে না পেরে ওদের চিৎকারে বিছানায় শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে আমার। পাগলের উকট চিৎকারে কে ঘুমাতে পারে! এক পাগল ছিল, মাঝে মাঝে ক্ষেপে যেত। যখন ক্ষেপত রাতভর, আল্লাহু আকবার’ ‘জিন্দাবাদ’ এই দুই কথাই বলে রাত কাটিয়ে দিত। কেউ কেউ সিপাহিদের ডাকত বিড়ি খেতে, বলত “বাবু ও বাবু এদিকে আসেন”–ডাকতেই থাকত, কিছুক্ষণ ডাকার পরে যদি না আসে তাহলে বাবুর পরিবর্তে মা বোন তুলে গালি দিত। চল্লিশ সেলের দুই ধারে ছোট ছোট কামরা, সিপাহিদের বলে কয়ে ক্ষেপা পাগলদের অন্য পাশে বন্ধ করতে অনুরোধ করতাম। কিন্তু কখন যে কোনোদিকের কে ক্ষেপে উঠে কি করে বসবে তার ঠিক নেই। আজ একজন ঘুমাইয়া ছিল, রাতে আর একজন শুরু করল। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে সবগুলিকে এক এক করে নিয়ে যায়, পানির হাউজে গোসল করায়। পাগল সহজে গোসল করতে চায় না, তাই জোর করে পানির ভিতর ফেলে দেয় আর চেপে ধরে। অনেক পাগল আবার চালাক, চুবানোর ভয়ে তাড়াতাড়ি কলের নিচে বসে নিজেই গোসল করে নেয়।
একদিন দাঁড়াইয়া পাগলের গোসল দেখছি। এক পাগলের গোসল হয়ে গেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে। আর একজন পাগলকে কয়েকজন কয়েদি ধরে এনে গোসল করাচ্ছে। যে পাগলটা আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে সে আমাকে বলে, কি দেখেন, এগুলি সব পাগল, খুব পাগলামি করে। আমি তো হেসেই অস্থির। নিজে যে পাগল তা ভুলে গেছে।
১৯৫৪ সালে জেলে গিয়ে এক পুরানা পাগলের সাথে দেখা হলো। ওকে আমি চিনতাম, কারণ বছরের মধ্যে প্রায় ১১ মাস ভাল থাকে, মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায়। যখন ভাল থাকে তখন খুব ভাল ভাল কথা বলে। ওদের যখন নিয়ে যাচ্ছে আমি দাঁড়াইয়া দেখছি, দেখি সেই পুরান পাগল। নাম তার কফিলউদ্দিন। জিজ্ঞাসা করলাম কি কফিলউদ্দিন কেমন আছো?’ বললো, ভাল তো আছি, ছাড়ে তো না। আপনারা তো ছাড়ালেন না। আবার বুঝি আসছেন। আর কিছু বললাম না। সে চলে গেল। রোজ যখন আমার সামনে দিয়ে নিয়ে যেতো তখন আমাকে দূর থেকে একটা আদাব করত। কফিলউদ্দিন আজও জেলে আছে—কতকাল থাকতে হয় জানি না। আর একজন ছিল আমাকে দেখলেই ইংরেজি বলতো। পরে খবর নিয়ে জানলাম, স্কুলের মাস্টার ছিল। পাগল হয়ে গেছে।
একদিন জেল গেটে যাচ্ছি আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে। যাবার পথেই ওদের দরজা। এক পাগল দাঁড়াইয়া আছে ওদের দরজায়। আমাকে দেখে বলে, কি খবর! সিগারেটগুলি একলাই খান আমাদের দিতে হয় না। বললাম সিগারেট খাবা, এসে দিব। ফিরে এসে দেখলাম ওদের তালাবন্ধ করে দিয়েছে। ওকে সহজে সেলের বাইরে করে না কারণ খুব শক্তিশালী। ক্ষেপে গেলে মেরে ধরে অস্থির করে দেয়। এক সিপাহি বসে বসে ডিউটি দিতে ছিল। ও আস্তে আস্তে এসে কাছে বসেছে, হঠাৎ সিপাহির হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে সিপাহিকে মারতে শুরু করল। সিপাহির মাথা ফেটে গেল। সিপাহি দৌড় দিয়ে কোনো মতে নিজেকে রক্ষা করল। পরে অনেক সিপাহি ও কয়েদি এসে ওর কাছ থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। এক ঘণ্টা পর্যন্ত ওর কাছে কেউ যেতে পারে নাই। দুই একজন সিপাহি আছে যাদের দেখলে পাগলরা ক্ষেপে যায়। তাই তাদের ডিউটি পাগল খাতায় দেয়া হয় না। পাগলের সঙ্গে রাগ করলে, গালাগালি করলে তারা আরও ক্ষেপে যায়। একমাত্র ঔষধ পানি। যদি বলা যায়, কাল সকালে তোকে পানির ভিতর ফেলে দেব তখনই ভয় পায়। আমি মাঝে মাঝে বিড়ি কিনে পাগলদের দিতাম, বড় খুশি হতো বিড়ি পেলে। এবার দিতে পারি নাই, কারণ আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে বের হওয়া বা কারও সাথে কথা বলা নিষেধ।
শয়তানের কল-আর একটা দফার নাম শয়তানের কল জিজ্ঞাসা করলাম, শয়তানের কল কি? কম্বল ফ্যাক্টরী। ঢাকা জেলে একটা কম্বল ফ্যাক্টরী আছে, ভাল ভাল কম্বল তৈয়ার হয়। বিশেষ করে জেলখানায় কয়েদিদের তিনটা করে কম্বল শীতের দিনে দেওয়া হয়, আর গরমের দিন দুইটা। ঢাকা জেলের কম্বল ফ্যাক্টরী সমস্ত জেলের কয়েদিদের কম্বল সাপ্লাই করে। এখানে কয়েদিদের কাজ করতে হয়। উল, তুলা বাইরে থেকে কিনে আনা হয়। যারা বেশিদিন জেলে আছে তাদেরই এখানে কাজ শেখানো হয়। এরা কম্বল তৈয়ার করে বাইরেও বিক্রি করে। আমি এক কয়েদিকে জিজ্ঞেস করলাম, শয়তানের কল বলো কেন? বলে, হুজুর তুলা যখন ওড়ে তখন আমাদের দিকে চাইলে চিনতে পারবেন না; সমস্ত চুল, মুখ, কাপড় তুলার কণায় ও
ধুলায় ভরে যায়। সন্ধ্যায় গোসল করে তবে আমরা খেতে পারি। সাফ সুতরা হয়ে গোসল না করলে আমাদের চিনতে পারবেন না, মাথা, মুখ, সারা শরীরে তুলা লেগে আমাদের চেহারা শয়তানের মতো হয়ে যায় বলে, শয়তানের কল নাম দেওয়া হয়েছে।
দরজি খাতা-ঢাকা জেলে চাদর, কয়েদিদের কাপড়, মোড়া, টেবিল, চেয়ার, খাট, গদি অনেক কিছুই এখানে তৈয়ার হয়। একজন ডেপুটি সুপারেনটেনডেন্ট এর চার্জে থাকে। একে কয়েদিরা ডিপটি বলে। দরজি খাতা খুব বড়ো এখান থেকে পুলিশ লাইনেরও পোশাক বানাইয়া দেওয়া হয়।
মুচি খাতা-মুচি খাতা আছে যেখানে জুতা তৈয়ার হয়। তবে একে আরও উন্নত ধরনের করা যায় যদি ভাল মেশিন সাপ্লাই করা হয় এবং কয়েদিদের কিছু বেতন দেয়ার বন্দোবস্ত করা যায়। কয়েদিরা কাজ করতে চায় না, ফাঁকি দেয়—শুধু দিন গোনে। আজ একদিন গেল, কাল দুই দিন—এমনি। যদি এরা বুঝতে পারে বেশি কাজ করলে টাকা পাওয়া যাবে তাহলে বেশি কাজ করত।