সিভিল সার্জন ও জেলের ডাক্তার সাহেবকে বললাম, যদি পারেন ভাল চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত করুন। এই অত্যাচারীদের কাছে মাথা নত করব না, মরতে হয় কারাগারেই মরব। পাপ আর পুণ্য পাশাপাশি চলতে পারে না। মৃত্যু যদি জেলেই থাকে, হবে। একদিন তো মরতেই হবে। সন্ধ্যায় ঘরের ভিতর বন্ধ করে দেয়, আর ভোরবেলা তালা খুলে দেয়। কি করে স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে পারে!
২৫শে মে ১৯৬৭ ॥ বৃহস্পতিবার
আজ জেলের ডিআইজি মওলানা ওবায়দুল্লা সাহেব সেল এলাকায় এসেছেন। কয়েদিদের নালিশ শুনতে। প্রায় আধাঘণ্টা আমার কাছে ছিলেন, অনেক বিষয় আলাপ আলোচনা হলো। বললাম, আমি তো এখন রাজনৈতিক বন্দি নই, এখন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। পুরাপুরি জেল কর্মচারীদের অধীনে। আইবির হুকুম বোধ হয় এখন নিতে হয় না। মওলানা সাহেব বললেন, “চিঠিপত্র আইবির মাধ্যমে যাওয়া আসা করবে এটা আইনে আছে। আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করার সময় সাদা পোশাকে পুলিশ কর্মচারী থাকতে পারে না।”
“আমাদের সূর্য অস্তের সময় যে তালাবন্ধের নিয়ম আছে সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য তা একঘণ্টা বাড়িয়ে দিবার নিয়ম করেছিলেন সেটা আপনারা অনুসরণ করুন, কারণ এই গরমে সূর্যাস্তের সময় তালাবন্ধ হয়ে ঘরের মধ্যে থাকা সম্ভবপর নয়।” অনেক আইন নিয়ে আলোচনা হলো। তারপর বললেন, আমি সরকারকে লেখব অনুমতির জন্য। এই সরকার রাজনৈতিক কর্মীদের বন্দি করে কষ্ট দেবার সকল পন্থাই অবলম্বন করেছে। এখানেও যাহা হবে বুঝতেই পারি।
দৈনিক সংবাদ কাগজটাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। শুধু প্রকাশকের নাম বদলাবার অনুমতি না দিয়ে ১৬ বৎসরের কাগজটা বন্ধ করে দিতে পারে কোনো সভ্য সরকার? আবার বলে বেড়ায় গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এদেশে নাকি খুবই আছে। যে ভাবে ও যে পথে সরকার চলছে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে তাহা আমি দিব্য চোখে দেখতে পারি।
আজ পিডিএম এর সভা শেষ হয়েছে, কয়েকটা প্রস্তাবও নিয়েছে।
২৭শে মে–২৮শে মে ১৯৬৭
ডিপুটি জেলার সাহেব খবর দিলেন ২৭ তারিখে জেলগেট কোর্টে আমার ১২৪ক ধারার মামলা শুরু হবে। আরও বললেন, আপনার ছেলেমেয়েদের সাথেও কাল দেখা করার অনুমতি পেয়েছেন। শরীর ও মন দুটোই খারাপ। অসহ্য গরম পড়েছে—যাকে বলা হয় ভ্যাপসা গরম। জেলের ভিতর এমনিই গরম থাকে। ১৪ ফিট দেওয়াল ঘেরা, বাতাস চেষ্টা করলেও আসতে কষ্ট হয়।
ভোর থেকে প্রস্তুত হয়ে আছি, কখন ডাক পড়বে ঠিক নাই। প্রথম খবর পেলাম হাকিম ১০টায় আসবেন। আবার খবর পেলাম ১১টায় আসবেন। আসতে আসতে প্রায় ১২টা বেজে গেছে। সিপাহি এসে বলল, “চলুন স্যার হাকিম এসেছেন সকলে বসে আছে।” তাড়াতাড়ি রওয়ানা হয়ে গেলাম।
জেলগেট নাজিমুদ্দীন রোডে, আর আমি থাকি ডিক্রি এলাকায় উর্দু রোডের পাশে। জেলটা ছোট না। যেয়ে দেখি জনাব সালাম সাহেব, জহিরুদ্দিন সাহেব, মশিয়ুর রহমান সাহেব, মাহমুদুল্লা সাহেব, আবুল হোসেন এডভোকেট এসেছেন। এদিকে একটু পরেই আমেনা, মোস্তফাও এসেছে। খুলনা থেকে আলি ও অন্যান্য কর্মীরা এসেছে। মামলা শুরু হলো। সরকারি উকিল জনাব আলীম সাহেব এসেছেন সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে। ভদ্রলোক এতবড় বেহায়া যাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। না জানে ইংরেজি, না জানে বাংলা, না জানে ভদ্রলোকদের সাথে আলাপ করতে। সরকারের নেমক খেয়েছে তার কর্তব্য পালনে একটু ত্রুটি নাই। তার নাকি একমাত্র গুণ হলো সাক্ষীদের ভাল করে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াতে পারে। তিনটা সাক্ষী হলো। জেরা পরে করা হবে। এটাও আমার পল্টন ময়দানের ১৯৬৪ সালের বক্তৃতার মামলা। দেড় ঘণ্টা সাক্ষী হলো, তারপর হাকিম চলে গেল। এডভোকেট সাহেবরা বসলেন আমাকে নিয়ে আলাপ করতে।
জহিরুদ্দিনের ইচ্ছা আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে ৮ দফার বিপরীত কোনো দাবি করা যাবে না। অর্থ হলো, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। ৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম কমিটিতে যোগদান করতে পারবে না। কাউন্সিল সভা হউক দেখা যাবে। যদি পার্টি যেতে চায় আমার আপত্তি কি? কতদিন থাকব ঠিক তো নাই। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শোষক ও শাসকগোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের নেতারা বুঝেও বুঝতে চায় না। নবাবজাদা নসরুল্লাহ সাহেব বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান না করলে তার সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যখন তিনি সভাপতি হয়েছেন পিডিএম-এর তখন তো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করে নাই। দেখলাম, জহির সাহেব ও সালাম সাহেব অসম্ভষ্ট হয়েছেন। মশিয়ুর ভাই আমাকে গোপনে বললেন, “লাহোর যেয়ে আমার কিছুটা ধারণা হয়েছে এর মধ্যে কিছু ষড়যন্ত্র আছে।“ আমাকে আরও বললেন, আমি যদি যোগদান না করি তবে তিনিও পিডিএম থেকে পদত্যাগ করবেন।
আমেনাকে বললাম, “৭ই জুন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করিও। হরতাল করার দরকার নাই। সভা শোভাযাত্রা পথসভা করবা।” সকলেই তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা ও অসুবিধার কথা বলল।