মওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণও করেছে। ১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি পিডিএম এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দস্তখত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া কোনো আপোষ হবে না। অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন। আমার ব্যক্তিগত মত ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। পরে জানাইয়া দেই। এও বলেছি এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দস্তখত করেছে তারা যেন সসম্মানে ফিরে আসতে পারে। তবে যদি পিডিএম কোনো আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছি-সহযোগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবেই করা হয়েছে। দেখলাম কাগজে আমার কথা মতই প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে :
‘The meeting of the E.P.A., League Working Committee discussed the 8-point programme of the PDM and resolved that the matter be referred to East Pakistan Awami League Council for final decision.
It is further resolved that pending decisions by the council the East Pakistan Awami League will extend it responsive cooperation to any movement of the PDM for the restoration of democratic rights of the peoples of Pakistan.
The meeting of the East Pakistan Awami League working committee reiterates its faith in the six-points programme and will continue the movement for its realization.’
ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আবদুর রশিদ ও নূরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম এ যোগদান করার জন্য লাহোর রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। তারাও সভায় যোগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায়। ৬ দফার আর প্রয়োজন নাই তাদের কাছে।
পিন্ডি থেকে জনাব কামরুজ্জামান এমএনএ, জনাব ইউসুফ আলী এমএনএ, জনাব নূরুল ইসলাম এমএনএ আওয়ামী লীগের এই তিন সদস্য পিডিএম সম্মেলনে যোগদান করেছেন। ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে এদের নিষেধ করা হয়েছে।
ন্যাপও পিডিএম এ যোগদান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিলে আন্দোলন কে করবে? সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ কর্মী ছাড়া অন্য দলের একটি কর্মীও জেলে নাই। ত্যাগ করলে এই দুই দলের নেতা ও কর্মীরা করছে। ঘরে বসে বিবৃতি দিয়ে এই দলের কর্মীরা রাজনীতি করে না। কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে এই পিডিএম করার পিছনে বিরাট ষড়যন্ত্র আছে।
লাহোরের সভায় পিডিএম কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাতে নবাবজাদা নসরুল্লাহকে সভাপতি আর মাহমুদ আলীকে সম্পাদক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিকে প্রেসিডেন্ট করার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এটা পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধোঁকা দেওয়ার ষড়যন্ত্র। কিছুতেই পারবে না—এ বিশ্বাস আমার আছে।
২৪শে মে ১৯৬৭ ॥ বুধবার
আজ ২৪শে মে সকালে সিভিল সার্জন সাহেব আমাকে দেখতে এসেছেন। কারণ আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার জন্য সরকার বোধ হয় জানতে চেয়েছেন আমার শরীরের অবস্থা। ওজন নিলেন, পাইলসের অবস্থা শুনলেন, মাথার যন্ত্রণা, পিঠে বেদনা ও গ্যাসট্রিক নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছি আমি। কয়েকদিন পূর্বে, বোধ হয় ১০/১২ দিন হয়ে গেছে মেডিকেল কলেজ থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এনে দেখার জন্য নোট দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ পর্যন্ত কেহই আসেন নাই বা আনা হয় নাই। মুক্তি তো আমাকে দেবে না। চিকিৎসাও ভালভাবে করবে না। আমার স্বাস্থ্য ভালই ছিল। খুবই পরিশ্রম করতে পারতাম, আজ আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। হাঁটতেও ইচ্ছা হয় না। বসে বসে কাটাই অথবা শুয়ে থাকি। একদিন সকালে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গিয়াছিলাম, পাশেই একটা বসার জায়গা থাকায় ধরে নিজকে সামলাইয়া নিয়েছিলাম। এত দুর্বল কেন যে হয়ে পড়লাম বুঝতে পারি নাই। রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বেশি কিছু বলি না কারণ ওরা চিন্তা করবে। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়লে জেল খাটব কেমন করে? জেলের ভিতর সামান্য অসুখ হলেই মন খারাপ হয়, মনে হয় কত বড় ব্যারামই না হয়েছে। বিশেষ করে আপনজনের কথা মনে পড়ে। আপনজনের সেবা চায় মন বার বার, বোধহয় এটাই নিয়ম, যা পাওয়া যায় না বা পাওয়া যাবে না তারই উপর আগ্রহ হয় বেশি। তাই ভাবি, জীবনের কত হাজার হাজার দিন এই কারাগারে একাকী কাটাইয়া দিলাম আর কতকাল কাটাতে হয় কেইবা জানে! তবুও দুঃখ আমার নাই, নীতি ও আদর্শের জন্য অত্যাচার সহ্য করছি। যুগে যুগে অনেক নেতা ও মনীষী নিজের আদর্শ এবং সত্যের জন্য জীবন দিয়েছে। কারাগারে বসে ধুকে ধুকে মারা গিয়েছে। তাদের কথা কেউই তো আজ মনে করে না। এই বাংলাদেশের কত ছেলে ইংরেজের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে জীবন দিয়েছে-তাদের নাম কেউ মনে করে না। কেহ যদিও মনে করে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হয়। এই বাংলাদেশের যুবকদের গলায় বাঙালিরাই তো ইংরেজের হুকুমে ফাঁসির দড়ি পরাইয়া দিয়েছে। একটু দুঃখ তো করে নাই, অনুতাপ তো দূরের কথা। বাংলার মাটির দোষই বোধহয়! যে বাঙালিরা আমাকে আসামি করছে, আটকাইয়া রাখছে, জেল দিতেছে—তারাও তো এই মাটিরই মানুষ এবং উচ্চ শিক্ষিত। এদের ছেলেমেয়ে ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যই তো আমি ও আমার মত শত শত কর্মীরা কারাবরণ করেছি। আরও কত লোকই না জীবন দিল তারই ভাইয়ের গুলিতে। এরাও একদিন বুঝবে, তবে সময় থাকতে না।