হাইকোর্ট থেকে একটা হুকুম পেয়েছি যে বক্তৃতার মামলায় জনাব মালেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সরকার হাইকোর্টে আপীল করেছেন। আগামী ২৯ তারিখে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি হবে বলে নোটিশ পেয়েছি। কাগজটা পাঠাইয়া দিয়েছি রেণু’র কাছে এডভোকেটদের সাথে পরামর্শ করে যে কোনো একজন ভাল এডভোকেট দিয়ে মামলা পরিচালনা করতে। এতগুলি বক্তৃতার মামলা দিয়েছে। দুইটায় সাজা হয়েছে, একটায় খালাস পেয়েছি, তার বিরুদ্ধেও আপীল করতে সরকারের কত উৎসাহ। যদিও এডভোকেট সাহেবরা টাকা নেয় না, তথাপি নকল ও অন্যান্য খরচ বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়। জেলে আছি উপার্জন নাই। ছেলেমেয়েদের খুবই অসুবিধা হবে। লড়তে হবে, উপায় কি? রাজনৈতিক কারণে মানুষ মানুষকে অত্যাচার করে তবে তার একটা সীমা আছে ও লজ্জা আছে। নিশ্চয়ই জনগণ বুঝতে পারে যে একটা লোককে ধ্বংস করার জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সরকার নিশ্চয়ই জানে যার কিছুই নাই তার আবার কিছু নষ্ট হবার ভয় কি?’ একটা দোষ’ বোধ হয় আমার আছে। সেটা হলো জনগণ আমাকে ভালবাসে এবং যে ৬ দফা দাবি করেছি তাহা সমর্থন করে, তাই বোধ হয় এই অত্যাচার। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে যে কোনো ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোনো প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য দাবি বলে জনগণ মেনে নিয়েছে। অত্যাচার করে তাহা দমানো যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়। যারা ইতিহাসের ছাত্র বা রাজনীতিবিদ, তারা ভাল করে জানেন। জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।
মণি জেল হাসপাতাল থেকেই ল’ পরীক্ষা দিতেছে, ভালই দিয়েছে খবর পেলাম। শাহ মোয়াজ্জেম আমার পাশেই পুরানা বিশ সেলে আছে। হাইকোর্ট ডিপিআর থেকে খালাস দিয়েছে কিন্তু একটা মামলায় জামিন না হওয়ার জন্য জেলে পড়ে আছে। নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীও পুরানা বিশে থাকার জন্য একটু আরামেই আছি। কারণ ওদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে পারি মাঝে মাঝে, ফাঁকে ফাঁকে তাসও খেলে থাকি। যদিও তাস খেলা ভাল জানি না। ব্রীজ খেলতে গেলে উল্টা-পাল্টা খেলে বসি। মোয়াজ্জেম আমার সাথী, মুখ কালা করে ফেলে, কিছু বলতেও পারে না আর সইতেও পারে না।
দুপুর বেলা বিছানায় শুয়ে থাকলে রাতে আর ঘুম হতে চায় না। তাই দুপুর বেলা খাওয়ার পরে কিছু সময় নষ্ট করি। আমি তো একাকীই থাকি, কোনো দেওয়াল ভিতরে না থাকায় ওরা চলে আসে। আর আমি তো কয়েদি হয়েছি, রাজনৈতিক বন্দি তো নই। আর মোয়াজ্জেমও বিচারাধীন আসামি। আর মোয়াজ্জেম কাছে থাকায় অনেক সময় গল্প করে কাটাতে পারি। মোয়াজ্জেম বলে, ‘মুজিব ভাই কিছু লেখেন।‘ আমি বলি, ‘কি লিখব, বল, লেখার অভ্যাস তো কোনোদিন করি নাই।‘
নূরুল ইসলাম ও নূরে আলম সিদ্দিকীর দুষ্টামী খুব ভাল লাগে। ব্রীজ খেলতে যখন পারি না তখন ব্রে খেলা শুরু করলাম। পরপর কয়েকদিন আমাকেই ব্রে হতে হলো কারণ ও খেলাটাও আমি ভাল জানি না। আমাকে নিয়ে ওরা মহা বিপদে পড়েছে। আস্তে আস্তে শিখে নিয়ে ওদেরও ব্রে করতে শুরু করলাম। পূর্বের মত আর একচেটিয়া অবস্থা নাই। তবে শাহ মোয়াজ্জেমকে ব্রে করা খুব কঠিন, দুই একবার ছাড়া করা যায় নাই। এখন ৱে খেলা চলছে। সকালে লেখাপড়া, দুপুরে খাওয়ার পরে কাগজপড়া ও ব্রে খেলা। সন্ধ্যার পরে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয় যার যার সেলে। আর আমাকে দেওয়ানী ওয়ার্ডে। সন্ধ্যা হলেই বই নিয়ে বসে পড়ি। দশটায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি, ঘুম হলেও শুয়ে থাকতে হবে আর না হলেও শুয়ে থাকতে হবে। বাইরে যেয়ে একটুও হাওয়া খাওয়ার উপায় নাই।
১৭ তারিখে রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। হাচিনা আইএ পরীক্ষা দিতেছে। হাচিনা বলল, “আব্বা প্রথম বিভাগে বোধ হয় পাশ করতে পারব না তবে দ্বিতীয় বিভাগে যাবো।” বললাম, “দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে মন দিয়ে পড়। দ্বিতীয় বিভাগে গেলে আমি দুঃখিত হব না, কারণ লেখাপড়া তো ঠিকমত করতে পার নাই।”
রাসেল আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। এক বৎসর হয়ে গেছে জেলে এসেছি। রাসেল একটু বড় হয়ে গেছে। জামাল আসে নাই, খুলনায় গিয়াছে। শুনলাম বাইরে খুব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। জেলা ও মহকুমার প্রেসিডেন্ট ও সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে। সভা আমার বাড়িতেই করতে হবে বলে একটিং সভাপতি ও একটিং সম্পাদক রেণুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকলে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও। আমার আপত্তি নাই।
আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। তাজউদ্দীন, মোমিন সাহেব, ওবায়দুর, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে রাজি নয়। খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সেও পিডিএমএর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে। তাজউদ্দীন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নূরে আলম, নূরুল ইসলাম-আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিক নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএম এর পক্ষে, কর্মীরা কেউই রাজি না। মানিক ভাইও পিডিএম এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএম দিয়েছে। আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নূরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের মানস পুত্র’ বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভাল। আমি এটা স্বীকার করতে পারি নাই-তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে। পূর্ব বাংলার লোকেদের ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মহম্মদ আলী। ৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমিও চাই, তবে এই সকল বড় বড় নেতারা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না তা আমার জানা আছে।