(২) কেন্দ্রীয় সরকার নিম্নলিখিত বিষয়গুলির দায়িত্ব গ্রহণ করিবে :
(ক) দেশক্ষা, (খ) বৈদেশিক বিষয়, (গ) মুদ্রা ও কেন্দ্রীয় অর্থনীতি, (ঘ) আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য এবং অন্যান্য যে বিষয়গুলি স্বীকৃত হইবে।
(৩) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হইবে, এবং অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত রেসিডিউয়ারী ক্ষমতা শাসনতন্ত্রের মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত সরকারের নিকট অর্পিত হইবে।
(৪) দশ বৎসরের মধ্যে উভয় প্রদেশের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণ করা সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকিবে। দেশরক্ষা, বৈদেশিক ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতি পূর্ব পাকিস্তানের আনুপাতিক ভাগ বাদ দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানেই ব্যয় হইবে। এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বাধীনে থাকিবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য বলবৎ থাকা পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে অগ্রাধিকার প্রদান করিবে। এবং এমন অর্থনীতি গ্রহণ করিবে যাহাতে পূর্বাঞ্চল হইতে মূলধন পাচার বন্ধ হইয়া যায়। এই উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্কের মওজুদ ও মুনাফা বীমা প্রিমিয়াম ও শিল্প ক্ষেত্রে মুনাফা সম্পর্কে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হইবে।
(৫) (ক) মুদ্রা, বৈদেশিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কিং, (খ) আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য, (গ) আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয়গুলির ভার জাতীয় পরিষদের সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক সদস্য সম্বলিত বোর্ডের উপর অর্পণ করা হইবে।
(৬) সুপ্রিম কোর্ট এবং কূটনীতিক সার্ভিস সহ কেন্দ্রীয় সরকারের সকল বিভাগের ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সম-সংখ্যক ব্যক্তি গ্রহণ করা হইবে। এই সংখ্যা সাম্য লাভের জন্য ভবিষ্যতের নিয়োেগ এমনভাবে করা হইবে যাহাতে দশ বৎসরের মধ্যে বৈষম্য দূর হয়।
(৭) পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকিবে। এই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারী একাডেমী, অস্ত্র নির্মাণ কারখানা, ক্যাডেট কলেজ ও স্কুল নির্মাণ করা হইবে। দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটা শাখায় তোক নিয়োগ করা হইবে এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হইবে। ইহা বাস্তবায়িত করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সমসংখ্যক সদস্য লইয়া একটা প্রতিরক্ষা কাউন্সিল গঠিত হইবে।
(৮) এই শাসনতন্ত্রের অর্থ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র। এই শাসনতন্ত্র অবিলম্বে ক্ষমতায় আসীন হইবার পর জারি করা হইবে এবং জারি করার ৬ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে কর্মসূচীর দুই ও সাত নম্বর ধারা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হইবে। সকল অঙ্গ দল ও সংস্থা এই উদ্দেশ্য সাধনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
২রা মে–৩রা মে ১৯৬৭
হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মিসেস আমেনা বেগম, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতি দেন ঐক্যফ্রন্টের চুক্তিতে স্বাক্ষর সম্বন্ধে। তারা বিবৃতিতে বলেন, ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে আওয়ামী লীগের শামিল হওয়া এবং ঐক্যফ্রন্ট গঠনের চুক্তিতে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর দানের বৈধতা সম্পর্কে।
আবার জহির সাহেবেরও একটি বিবৃতি দেখলাম। মহা চিন্তায় পড়লাম। অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলাম। তারপর কলম ধরলাম। আমার মতামত দেওয়া প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যাহা চেয়েছিল তাহাই হলো। আওয়ামী লীগ ভাঙতে। এখন দুই দলের ইজ্জতের প্রশ্ন হয়েছে। আমি আশ্চর্য হলাম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রস্তাব দেখে। পাকিস্তান অবজারভারের ২রা মে-র কাগজে এই প্রস্তাবটি উঠেছে তাতে লেখা আছে :
‘The All Pakistan Awami League Working Committee at its meeting in Dacca on April 23 discussed Six-Point Programme of East Pakistan Awami League. On the basis of this programme it evolved a formula in which besides the restoration of complete democracy in the country the genuine demands of East Pakistan People were incorporated. This formula was unanimously adopted by the East Pakistan Awami League also as the basis for negotiations with other political Parties. Says press release’.
আমি বুঝতে পারলাম না কেমন করে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে এই আট দফা দাবির মধ্যে।
৩রা মে–২৩শে মে ১৯৬৭
কিছুদিন থেকে শরীরের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। প্রায় ৭ সের ওজন কমে গেছে। অর্শ রোগ হওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রক্ত পড়ে পায়খানার দ্বার দিয়ে। শরীরের প্রতি যত্ন নিয়েও কিছু হচ্ছে না। দুর্বল হয়ে পড়েছি। ৩রা মে দেশরক্ষা আইনে (বিনা বিচারে) শেষ তিন মাসের সরকারি হুকুমনামা আমাকে দেওয়া হয় নাই। এক বৎসর শেষ হয়ে গেছে ৩রা মে তারিখে। ৪ তারিখে হুকুম পাব আশা করেছিলাম। বুঝতে পারলাম আমার ১৫ মাস জেল হয়েছে। আমি দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি তাই হুকুম নামা দেওয়া হয় নাই। এখন আমি শুধু দণ্ডভোগ করছি। আপীল দায়ের করা হয়েছে সাজার বিরুদ্ধে। আপীল মঞ্জুরও হয়েছে। আগামী ২৯ তারিখে জামিন সম্বন্ধে শুনানি হবে ঢাকা জেলা জজের কাছে। যদি জামিন পেয়ে যাই তবে সরকার আবারও আমাকে ডিপিআর-এ বিনা বিচার আইনে বন্দি করে রাখবেন। ১৯শে জুন তারিখে মামলার শুনানি হবে বলে জজ সাহেব বলে দিয়েছেন।