রেণু শুনল। এখন যাহা পাই একলার পাক করে খাওয়া কষ্টকর। আমাকে বলল, কিছু প্রয়োজন আছে কিনা? বললাম, দেখা যাক কি হয় তারপর দরকার হলে জানাব। রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মার কোলে, একবার টেবিলের উপরে উঠে বসে। আবার মাঝে মাঝে আপন মনেই এদিক ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্ট হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলল, ‘আব্বা দেখেন আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে। আমি ওকে বললাম, তুমি রেহানাকে মার? রাসেল বলল, হ্যাঁ মারি। বললাম, না আব্বা আর মেরো না। উত্তর দিল, মারবো।’ কথা একটাও মুখে রাখে না। জামাল বলল, ‘আব্বা আমি এখন লেখাপড়া করি।’ বললাম, ‘তুমি আমার ভাল ছেলে মন দিয়ে পড়িও। সন্ধ্যা হয়ে এলে ছেলেমেয়েদের চুমা দিয়ে ও রেণুকে বিদায় দিলাম। বললাম, ভাবিও না অনেক কষ্ট আছে। প্রস্তুত হয়ে থাকিও।
ফিরে এলাম। একটু পরেই তালাবন্ধ হয়ে গেল। আমিও বই নিয়ে বসলাম। রাত্র দশটা পর্যন্ত লেখাপড়া করি আজকাল। তারপর খেয়ে শুয়ে পড়ি। কোনো দিন শুয়েই ঘুম এসে যায় আবার কোনোদিন পাগল ভাইদের চিঙ্কার শুনি মশারির ভিতরে শুয়ে।
২৯ তারিখ সকালে বসে কাগজ পড়ছি, ডাক্তার সাহেব আমাকে দেখতে আসলেন। বললাম, রোগ ও শোক এই দুইটাতো কারাগারের সাথী-কি আর দেখবেন? সকালে ১০টা-১১টা পর্যন্ত কাগজ অথবা বই পড়ি। ১২টার সময় দেখি রেণু কয়েক সের চাউল, কিছু ডাউল, তেল, ঘি, তরকারি, চা, চিনি, লবণ, পিয়াজ ও মরিচ ইত্যাদি পাঠাইয়াছে। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ডিভিশন ক’ কয়েদিরা বাড়ির থেকে এসব আনতে পারে ডিআইজি প্রিজনের অনুমতি নিয়ে। অনুমতি নিয়েই পাঠাইয়াছে দেখলাম। ভালই হয়েছে। কিছুদিন ধরে পুরানা বিশ সেলে যে কয়েকজন ছাত্র বন্দি আছে তারা খিচুড়ি খেতে চায়। বহুদিন আমাকে বলেছে কিন্তু কুলাতে পারব না বলে নড়াচড়া করি না। কিছু কিছু বাঁচাইয়াছি, কয়েকটা মুরগি, কিছু ডিমও জোগাড় করেছি। নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আরও কয়েকজন মিলে খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছে। খিচুড়ি আদায় করতেই হবে। একদিন হঠাৎ আমার পাকের ঘরের কাছে একটা কাঁঠাল গাছ আছে, সেখানে খবরের কাগজে কালি দিয়ে লিখে কাঁঠাল গাছে টানাইয়া রেখেছে কোনো কয়েদিকে দিয়ে। তাতে লেখা আছে আমাদের দাবি মানতে হবে, খিচুড়ি দিতে হবে। নীচে লেখা ‘খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ’। আমি তো নূরুল ইসলামের হাতের লেখা চিনি। বাইরে ও পোস্টার লেখতো। তারই হাতে লেখা। আমি তাদের ডেকে বললাম, এসব দাবি টাবি চলবে না। দরকার হলে জনাব মোনেম খানের পন্থা অবলম্বন করব। খুব হাসাহাসি চললো। মাঝে দুই একজনে দুই একবার শ্লোগানও দিয়েছে-খিচুড়ি দিতে হবে।
আজ সুযোগ হয়ে গেল। মালপত্র পাওয়া গেল। বিকালে তাদের বললাম যাহা হউক তোমাদের ভাবির দৌলতে তোমাদের খিচুড়ি মঞ্জুর করা গেল। আগামীকাল খিচুড়ি হবে।
যথারীতি রবিবার সকাল থেকে খিচুড়ি পাকের জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা হলো। রেণু কিছু ডিমও পাঠাইয়াছে। কয়েকদিন না খেয়ে কয়েকটা ছোট ছোট মুরগির বাচ্চাও জোগাড় করা হয়েছে। আমি তো জেলখানার বাবুর্চি, আন্দাজ করে বললাম কি করে পাকাতে হবে এবং আমার কয়েদি বাবুর্চিকে দেখাইয়া দিলাম। পানি একটু বেশি হওয়ার জন্য একদম দলা দলা হয়ে গেছে। কিছু ঘি দিয়ে খাওয়ার মত কোনোমতে করা গেল। পুরানা বিশ সেলে আট জন ডিপিআর, তাদের ফালতু, পাহারা, মেট চারজন করে দেওয়া হলো। আমার আশে পাশেও ৮/১০ জন আছে সকলকেই কিছু কিছু দেওয়া হলো। ডিম ভাজা, ঘি ও অল্প অল্প মুরগির গোস্তও দেওয়া হলো। গোসল করে যখন খেতে বসলাম তখন মনে হলো খিচুড়ি তো হয় নাই তবে একে ডাউল চাউলের ঘণ্ট বলা যেতে পারে। উপায় নাই খেতেই হবে কারণ আমিই তো এর বাবুর্চি। শাহ মোয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম বলল, মন্দ হয় নাই। একটু হেসে বললাম, যাক আর আমার মন রাখতে হবে না। আমিই তো খেয়েছি। যাহা হউক খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদের দাবি আদায় হলো, আমিও বাঁচলাম।
বিকালে শুনলাম মণিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, শরীর খারাপ করেছে। দুইদিন পরে আইন পরীক্ষা দিবে। একটু চিন্তাযুক্ত হলাম। খবর নিয়ে জানলাম, চিন্তার কোনো কারণ নাই।
১লা মে–২রা মে ১৯৬৭
খবরের কাগজের মারফতে দেখতে পেলাম কয়েকটি বিরোধী দল ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে একটা ঐক্য জোট গঠন করেছে। ঐক্য জোটের নাম দেওয়া হয়েছে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন। কর্মসূচি পূর্বেই আমি পেয়েছি।
ঐক্যজোটের চুক্তিতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, আবদুস সালাম খান এবং গোলাম মোহাম্মদ খান লুখোর, কাউন্সিল মোছলেম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানা, খাজা খয়ের উদ্দিন এবং তোফাজ্জল আলি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের জনাব নূরুল আমীন, জনাব আতাউর রহমান খান এবং হামিদুল হক চৌধুরী, জামাতে ইসলামী পার্টির জনাব তোফায়েল মোহাম্মদ, জনাব আবদুর রহিম এবং জনাব গোলাম আজম, নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মহম্মদ আলি, জনাব ফরিদ আহম্মদ এবং এম আর খান স্বাক্ষর করেন।
৮ দফা কর্মসূচী
(১) পার্লামেন্টারী পদ্ধতির ফেডারেল সরকার।
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্য। পূর্ণাঙ্গ মৌলিক অধিকার, সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।